সরকারের অনুমতি নিয়ে রাস্তায় মিছিল-সমাবেশ করলে আন্দোলন সফল হবে না -দিলারা চৌধুরী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
বিএনপির চলমান মুভমেন্ট দিয়ে সরকার পতন ঘটানো সম্ভব হবে না -গোবিন্দ চক্রবর্তী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
- শান্তনীতি ও নতজানু কর্মসূচিতে সরকার কখনো পরিবর্তন হবে না
- হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগের ইতিহাস আমলে নিচ্ছে বিএনপি
- মাঠের জনশক্তিকে বাদ দিয়ে বিএনপি হাঁটছে ছোট দলের শক্তিতে
অনুমতি নিয়ে চলছে বিএনপির আন্দোলন। ১০ দফা দাবি আদায়ে বিক্ষোভ, গণঅবস্থান, গণমিছিল মিছিল সব কর্মসূচিই
হচ্ছে সরকারের সহযোগিতায়।
দলটির গতিবিধিতে নজর রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপি যে শান্তির কর্মসূচিতে চলছে, নতজানু হয়ে কর্মসূচি পালন করছে তাতে সরকার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। দাবি আদায়ে অতীতে আওয়ামী লীগ যে রূপে ছিল সে অবস্থান ছাড়া কোনোভাবেই সরকারকে বাধ্য করা সম্ভব নয়। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আরও কিছু নীতিনির্ধারক আন্তর্জাতিক দেশগুলোর শান্তনীতিতে চলছে। যাচ্ছে না বড় কর্মসূচিতে। শুধু সরকারের অনুমতিসাপেক্ষে কর্মসূচিগুলো থেকে হুঙ্কার দেয়া হচ্ছে ১০ দফা দাবি বাস্তবায়নের। সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের।
বিএনপির মাঠপর্যায়ের জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, নির্বাচনের পূর্বে প্রতিটি সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতীতেও দেখা গেছে, জোট আর ঐক্যের দিকে মনোযোগী হয়ে সময়ক্ষেপণ হয়েছে। এবারও সেই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। চার জোটে বিভক্ত হয়ে ৫২ দলের এক সাথে কর্মসূচি। এতে করে সরকারের কিছুই হবে না। সরকার যতই সময় পাচ্ছে ততই মাঠ গুছিয়ে নিচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিএনপির অতীতের মতো কিছুই করার থাকবে না। বিএনপি যদি ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছে থাকে, রাষ্ট্র সংস্কারের দৃষ্টি থাকে তাহলে চাপ প্রয়োগের সর্বোচ্চ শক্তি এখনই দেখাতে হবে।
রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে আন্দোলনের অনেক সফল ইতিহাস রয়েছে। ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন হয়েছিল, এতে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল জেনারেল এরশাদকে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে `তত্ত্বাবধায়ক সরকার`-এর দাবিতে গণআন্দোলন হয়েছে। যার কার্যত নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। দাবি আদায়ের ইতিহাসে সে ঘটনাগুলো আন্দোলনের প্রকৃত রূপ বলে বার্তা বহন করে যাবে বলে অনেকে মনে করছেন।
১৯৯৬ সালের সেই জানুয়ারি মাস। তৎকালীন বিএনপি সরকার যখন একপেশে সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বিরোধী দল আওয়ামী লীগ তখন রাস্তায় তুমুল আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। হরতাল, অবরোধ, হামলা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দেশ তখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দলের খালেদা জিয়া মুখে যতই বলেছেন তিনি চাপ অনুভব করছেন না, আন্দোলনে কিছুই হবে না কিন্তু বেলা শেষে দৃশ্যপট বদলে যায়। আন্দোলন শুরুর ৯ মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা। পদত্যাগের রাস্তা বেছে নেয় জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় পার্টির এমপিরাও পদত্যাগ করেন।
১৯৯৫ সালের পুরো বছরজুড়ে হরতাল এবং অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করতে থাকেন। খালেদা জিয়া যেখানে সমাবেশ করতে যাচ্ছিলেন সেখানেই হরতালের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। খালেদা জিয়া তার নির্বাচনি এলাকা ফেনীতে সমাবেশ করতে গেলে সেখানেও তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েন। সেখানে বিরোধী দলগুলো হরতালের ডাক দেয় এবং কালো পতাকা প্রদর্শন করে। পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় ফেনীতে দুটো সমাবেশ বাতিল করতে বাধ্য হন তিনি। রাজনৈতিক সহিংসতা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিভিন্ন জেলায় বিএনপি নেতাদের বাড়ি কিংবা অফিসে হামলা হয়। খালেদা জিয়া রাজশাহীতে সমাবেশ করতে গেলে সেখানে তার সমাবেশের কাছেই বোমাহামলায় একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি বহর লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করা হয় বলে বিভিন্ন সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনে সড়ক, নৌ এবং রেল যোগাযোগ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় অন্তত ১০ জন নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রে।
আওয়ামী লীগ টানা ১০৮ ঘণ্টার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। বড় সহিংসতা হয় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, দোকানপাটে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেনাবাহিনীর একটি জিপ গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। সে ইতিহাস এখনো আন্দোলনের প্রকৃত রূপ বলে অনেকে মনে করছেন। বর্তমানে আবারও আরেকটি দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ভালো নেই দেশের পরিস্থিতি। গ্যাসের দাম বাড়ল, বিদ্যুতের দাম বাড়ল। অর্থনৈতিক দুরবস্থা। সরকারের অধীনে আবারো নির্বাচন। এমন অবস্থায় ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটাতে আরেকটি গণআন্দোলন সৃষ্টি করতে চাচ্ছে বিএনপি। দেয়া হয়েছে দুটো দফা। ১০ দফার মাধ্যামে সরকারের বিদায় এবং ২৭ দফার মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে আন্দোলনে নামছেন।
কিন্তু বর্তমানে বিএনপি যেসব কর্মসূচি দিয়ে `যুগপৎ আন্দোলন` করছে সেটি দাবি পূরণে কতটা কাজে দেবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে অনেকের। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগও আন্দোলন মোকাবিলায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আওয়ামী লীগের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা। এছাড়া অনেক শক্তি ও অভিজ্ঞতা রয়েছে দলটির ঝুড়িতে। আর বিএনপির রয়েছে মাত্র দু- একটি দেশের সাহায্যের ইঙ্গিত। কিন্তু সরকারের প্রতিরোধ মোকাবিলা করে কোনো কর্মসূচি পালন করবে এখনো পর্যন্ত দলটির শক্তি দেখা যাচ্ছে না।
গত ১০ ডিসেম্বর সরকারের বাধায় নয়াপল্টনে সরকারের বাধায় সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। এরপর সরকারের দেখানো স্থানে গোলাপবাগে সমাবেশ করে দলটি। ওই সময় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন যখন মাইকে কর্মসূচি ঘোষণা দিচ্ছেন তখন দলটির নেতাকর্মীরা চিৎকার করতে থাকেন, হরতাল, অবরোধ, ইসি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও। কিন্তু মোশাররফ বলেন এখনো সময় হয়নি। দেয়া হয় শান্ত কর্মসূচি।
গত ২৪ ডিসেম্বর ৯ বিভাগীয় শহরে, ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি গণমিছিল এবং ১১ জানুয়ারি অবস্থান কর্মসূচি, ১৬ জানুয়ারি মহানগরে বিক্ষোভ সমাবেশ পালন এবং ২৫ জানুয়ারি সমাবেশ করে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। এসব কর্মসূচি পালন হয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে। এভাবে অনুমতি নিয়ে আন্দোলন করলে বিএনপির সফলতার সম্ভাবনা দেখছেন না দেশের অভিজ্ঞরা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, এই সরকার একটা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলছে। দ্বিতীয়ত, সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক কাঠামোটা নেই। আর তৃতীয়ত হলো, বিএনপি যে পর্যায়ে মুভমেন্ট করছে এ রকম মুভমেন্ট দিয়ে সরকার পতন ঘটানো কিংবা ওই ধরনের দাবি আদায় করা কঠিন।
গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি বিএনপি এখনও দিতে পারেনি বলে মন্তব্য করে আরেক জোষ্ঠ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেছেন, খালি মিছিল আর সভা-সমাবেশ করে সরকারকে তাদের দাবির মুখে নত করতে পারবে না। তাদের আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে এবং বিএনপির এ কথাটা মনে রাখতে হবে যে, বিএনপি একাই কিন্তু এই আন্দোলনটা চালিয়ে যেতে হবে। সরকারের অনুমতি নিয়ে রাস্তায় মিছিল-সমাবেশ করলে আন্দোলন সফল হবে না। সরকারের অনুমতি নিয়ে একটা মিছিল করলে আর ১০টা সভা করলে সরকার একটুও বিচলিত হবে না বলে আমি মনে করি। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই যেহেতু রাজপথে আছে বিএনপি সেদিক থেকে ২০২৩ সাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে একটা গরুত্বপূর্ণ বছর। পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচন বিতর্কিত হওয়ার কারণে বিএনপির দাবির প্রতি সমর্থন আছে বাংলাদেশের অনেক মানুষের।