প্রাণহানিতেও থামছে না সিটি টোল

নুর মোহাম্মদ মিঠু প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৩, ০১:১৮ এএম
প্রাণহানিতেও থামছে না সিটি টোল
  • তিন বছরে শুধু যাত্রাবাড়ীতেই ট্রাকচাপায় মারা গেছে অবৈধ পাঁচ টোল আদায়কারী
  • মেজাজ হারিয়ে ঢাকায় পিষ্ট করছে চালকরা 
  • সিটি কর্পোরেশনের মনোগ্রাম ব্যবহার বন্ধ করায় অবৈধ টোল আদায়ের সুযোগ বেড়েছে

গত বছর থেকেই সিটি কর্পোরেশনের মনোগ্রাম ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে -পরিবহন বিভাগ, ডিএসসিসি
সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট আছে, তারা ব্যবস্থা নেয় না কেন -প্রশ্ন ডিএমপির

সিটি কর্পোরেশনের ইজারার বাইরেও ঢাকায় যত্রতত্র আদায় করা হচ্ছে সিটি টোল। এসব টোল আদায় করতে গিয়ে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। তাতেও থামছে না অবৈধভাবে টোল আদায়। 

সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, অবৈধভাবে টোল আদায়ের কোনো সুযোগ নেই। নেই সিটি কর্পোরেশনের মনোগ্রাম ব্যবহারের সুযোগও। গত বছর থেকেই সিটি কর্পোরেশনের মনোগ্রাম ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। যদিও এ প্রক্রিয়া বন্ধ করায় অবৈধভাবে টোল আদায়ে বাড়তি সুযোগই পেয়েছে টোল আদায়কারীরা। নিজেদের ইচ্ছেমতোই যখন তখন টোলের নামে সড়কে দাঁড়িয়ে করছে চাঁদাবাজি। 

রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব টোল আদায়ের কোনো বৈধতাই নেই। এদিকে অবৈধ এসব টোল দিতে নারাজ ক্ষুব্ধ ট্রাকচালকরাও ইচ্ছে করেই চাপা দিচ্ছেন। টোল আদায়কারীদেরও। গত তিন বছরে শুধু যাত্রাবাড়ীর কাজলা ও শনির আখড়া এলাকায় টোল আদায় করতে গিয়ে। ট্রাকচাপায় নিহত হয়েছেন পাঁচজনেরও বেশি। অবৈধ হওয়ায় এসব ঘটনার অধিকাংশই থেকে যাচ্ছে আড়ালে। যে কারণে জানা যাচ্ছে না এমন মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যানও।

সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের শনির আখড়া আন্ডারপাসের ওপরে টোলের নামে চাঁদা আদায় করতে গিয়ে ট্রাকচাপায় নিহত হন শুভ নামের একজন। নিহত শুভ স্থানীয় শেখদী এলাকার বাসিন্দা। এ ঘটনায় কোনো অভিযোগও করেনি তার পরিবার। 

স্থানীয় সূত্র জানায়, অবৈধভাবে টোল আদায় করতে গিয়ে মারা যাওয়ায় এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি শুভর পরিবার। ২০২১ সালে মারা যায় রুস্তম আলী নামের আরেক টোল আদায়কারী। নিহত রুস্তম কাজলা পেট্রলপাম্প এলাকার বাসিন্দা। কাজলা ফুটওভারব্রিজের নিচে ট্রাকচাপায় নিহত হন রুস্তম। তার মৃত্যুর ঘটনাতেও পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ করা হয়নি। ২০২২ সালে মারা যান রাব্বি নামের আরেকজন। তিনি কাজলার ছনটেক এলাকার বাসিন্দা। 

এ ছাড়াও গত ২৫ ডিসেম্বর মারা যান কাজলার নয়ানগর এলাকার আরেক বাসিন্দা। তার নাম পরিচয় জানা যায়নি। পরিবারের কেউ আদৌ তার মৃত্যু নিয়ে কোনো অভিযোগও করেননি বলে জানান স্থানীয়রা। পরিবারের কেউ এ নিয়ে কথা বলতেও রাজি নন। তিনি মারা যান কাজলার ফাতেমা নাজ পেট্রল পাম্পের সামনে। একই স্পটে মারা যান একই এলাকার চান মিয়া রোডের আরেক বাসিন্দা। তার নামও জানা যায়নি। 

স্থানীয়রা বলছেন, তাদের মৃত্যু নিয়ে পরিবারের কেউই কোনো কথা বলতে নারাজ। পুলিশ বলছে, ট্রাক চালকরা নির্ধারিত এলাকায় বা স্ট্যান্ডে চাঁদা দেয়ার পর এসব অবৈধ টোল নিয়ে বিরক্ত। অবৈধভাবে টোলের নামে আদায় করা এসব চাঁদা দিতে নারাজ তারা। যে কারণে এসব টোল আদায়কারীরা ট্রাকের সামনে এসে দাঁড়ালে অধিকাংশ চালকই মেজাজ হারিয়ে গায়ের ওপরে উঠিয়ে দেন। আবার চালকদের অনেকেই মাদকাসক্তও থাকেন। মাদকাসক্ত অবস্থায় টোল আদায়কারীরা ট্রাকের সামনে এলে মেজাজ হারিয়ে গাঁয়ের ওপর তুলে দেন। 

সাম্প্রতিককালে কাজলা এলাকায় কয়েক রাতে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, টোল আদায়কারীরা ছোট ছোট লাঠি হাতে সড়ক দাবিয়ে বেড়াচ্ছে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা অতিক্রম করে আসলেই ট্রাকের সামনে দাঁড়াচ্ছে টোল আদায়কারীরা। যেসব ট্রাক চালকরা টোল দিতে অনীহা জানাচ্ছেন তাদের ওপর হামলাও করছে। লাঠির আঘাতে ভেঙে ফেলা হচ্ছে ট্রাকের লুকিং গ্লাস, সামনের উইন্ডশিল্ড। কখনো কখনো চালককেই করা হচ্ছে লাঠির আঘাত। টোল আদায়কারীদের এতটাই বেপরোয়া দেখা গেছে যে- কখনো কখনো চালককে আসন থেকেও টেনেহিঁছড়ে নামিয়ে করা হচ্ছে মারধর। 

স্থানীয় সূত্র বলছে, গত বছরের শেষের দিকেও এক ট্রাকচালককে দাঁড় করিয়ে চাঁদা দাবি করে টোল আদায়কারীরা। তাদের চাহিদামতো চাঁদা দিতে অনীহা প্রকাশ করায় ট্রাক থেকে নামিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয় ওই চালককে। এক পর্যায়ে ইটের আঘাতে ওই চালকের মুখমণ্ডল ও মাথা থেঁতলিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার ওই ঘটনায় একটি হত্যা মামলাও হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। মামলায় বেশকজনকে আসামি করা হলেও দু-একজন ব্যতীত বাকি আসামিরা বর্তমানে জামিনে রয়েছে। 

শুধু তাই নয়— গত ২৩ জানুয়ারি কাজলার আগের স্পর্ট কুতুবখালিতেও টোল আদায় করাকে কেন্দ্র করে হত্যার শিকার হন নয়ানগর এলাকার বাসিন্দা ইমরান। প্রতিপক্ষ গ্রুপের হামলায় নিহতের এই ঘটনায় মামলাও করেন নিহতের স্ত্রী পপি। ওই মামলায় স্থানীয় কাউন্সিলর মাসুম মোল্লাসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়। ২০-২৫ জনকে করা হয় অজ্ঞাত আসামি। 

পপি বলেন, তার স্বামীকে টোল আদায়রত অবস্থায় হত্যা করা হয়। প্রকাশ্যে টোল আদায় করতে গিয়ে খুনোখুনির এসব ঘটনায় পরিবার বাদী হয়ে মামলা করলেও ট্রাক চাপায় নিহতের ঘটনায় মুখই খোলে না পরিবার। যে কারণে পুলিশের কাছেও নেই এসবের সঠিক তথ্য কিংবা পরিসংখ্যান। 

তবে এসব মৃত্যু বন্ধে সিটি টোলের নামে অবৈধভাবে চাঁদা আদায় অচিরেই বন্ধ করতে হবে- এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। 

জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পরিবহন বিভাগের মহা-ব্যবস্থাপক (যুগ্মসচিব) হায়দর আলী আমার সংবাদকে বলেন, যাত্রাবাড়ীর কাজলায় সিটি টোল আদায় হলেও তা সায়েদাবাদের অধীনে কি-না দেখতে হবে। তবে কেউ সিটি কর্পোরেশনের মনোগ্রাম ব্যবহার করে টোল আদায় করতে পারবে না। যারা ইজারা পেয়েছে তারাও না। এটি গত বছর থেকেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ মনোগ্রাম ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করায় চাঁদা আদায়ে আরও বেশি সুযোগ পাচ্ছে অবৈধভাবে টোল আদায়কারীরা। 

জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট আছে তারা এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে। 

নেয় না কেন? তা ছাড়া তাদের মনোগ্রাম ব্যবহার করে তাদের লোকেরাই এসব টোল আদায় করছে। ডিএমপির কী কিছুই করার নেই এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কেউ যদি চাঁদাবাজির মামলা করে তাহলে অবশ্যই ডিএমপি ব্যবস্থা নেবে। তবে এসব ঘটনায় নিহতের সঠিক পরিসংখ্যান নেই ডিএমপিতেও।