ঢাকায় জনভোগান্তি কমবে

আবু ছালেহ আতিফ প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৩, ০২:৩১ এএম
ঢাকায় জনভোগান্তি কমবে
  • পাঁচ বছরের মধ্যে স্যাটেলাইট টাউনশিপ গড়ে তোলার পরিকল্পনা

 

কেরানীগঞ্জ ও সাভারে প্রকল্প গ্রহণের জন্য সমীক্ষা কার্যক্রম শেষ

—রাজউক

 

ঢাকার বাইরের কর্মসংস্থানগুলোতে কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে

—অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান

 দিন দিন বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা। ঢাকামুখী নতুন মানুষের ভিড় এটাকে আরও নাভিশ্বাসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাস্তায় বের হলেই নানামুখী মানুষের ঠাসাঠাসিতে নাজেহাল অবস্থা নগরীর প্রতিটা কোণায়। সবার অভিযোগ, অতিরিক্ত মানুষের ভিড়ের সাথে নতুন মানুষের আনাগোনাই এর জন্য দায়ী। আর এ জনঘনত্বের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, শব্দদূষণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা, মলমূত্র ত্যাগের মতো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। সব মিলিয়ে সমাজের বিভিন্ন মহলের প্রশ্ন, ঢাকাতেই কেন এত যন্ত্রণা। অন্যদিকে ঢাকাকে বাসযোগ্য পরিবেশ হিসেবে তৈরিতে এখন পর্যন্ত যত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তাও সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বরং অপরিকল্পিতভাবে বাড়ছে জনঘনত্ব।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, প্রতি বছর ঢাকা শহরের জনসংখ্যায় নতুন করে যোগ হচ্ছে ছয় লক্ষাধিক মানুষ। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে মূল ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেখান থেকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের জন্য অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মূল ঢাকার জনঘনত্ব কমবে। আর জনঘনত্ব কমলে ঢাকা অনেকাংশেই বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠবে। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। দিনমজুর থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী সবার পছন্দ যেন বসবাসের অনুপযুক্ত রাজধানী ঢাকা। এত ভোগান্তির পরও কেন সবাই ঢাকায় আসছেন তার খোঁজে উঠে আসে কিছু বাস্তবতা।

গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন কর্মসংস্থান কেন্দ্র, ফুটপাত, আদালত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে এ জনঘনত্বের প্রধান কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। মূলত কর্মসংস্থান, গৃহহীনদের আশ্রয়, উন্নত শিক্ষা, ভালো চিকিৎসা সবকিছুর জন্য মানুষ বেছে নিচ্ছে ঢাকাকেই। সরেজমিন দেখা যাচ্ছে, ঢাকাতে যতটা সহজে কাঁচা টাকা আয় করা সম্ভব তা গ্রামাঞ্চলে সম্ভব না। যার ফলে সাধারণ পেশার মানুষের প্রধান নজর থাকে ঢাকায়।

রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, রাজধানীতে সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থানের জন্য রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ জনঘনত্বের হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত  জনঘনত্ব ৫০০ জন। এর ভেতর আবার দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ সিটিতে মানুষের চাপ আরও বেশি।

কুড়িগ্রাম থেকে রিকশা চালাতে রমজানের প্রথম দিকে ঢাকা এসেছেন কবির (৩৪)। ঢাকা ছাড়া নির্ভর করার মতো আয়ের স্থল নেই বলছেন কবির। এ রিকশাচালক বলেন, গ্রামে থেকে টুকটাক যা ইনকাম হয় তা আসলে বর্তমান বাজার হিসেবে কিছুই না। আবার গ্রামে কাজও নেই। কিন্তু ঢাকা এলে রিকশা নিয়ে বের হলেই খরচ বাদ দিয়েও যা থাকে তা চলার মতো।

খুলনা থেকে ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজে অনার্স দিত্বীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন আবরার হোসেন। খুলনায়ও তো পড়া যেত ঢাকায় এত ভোগান্তি করেও কেন পড়তে হবে— প্রশ্নের জবাবে আবরার আমার সংবাদকে বলেন, আসলে ঢাকায় ভোগান্তি হলেও এখানে বাস্তবতা শেখা যায় বেশি। বর্তমান চাকরির বাজারের যে প্রতিযোগিতা এবং সব অফিস আদালত রাজধানীতে এসবের সাথে নিজেকে এগিয়ে রাখতে মূলত ঢাকায় থাকা।

ঢাকার জজকোর্টের অ্যাডভোকেট মো. সোহেল। তার বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারী। ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় চাকরি করে থাকার সখ। তিনি বলেন, ঢাকা যদিও সবকিছু মিলিয়ে বসবাস অনুপযোগী, তবুও পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এখানে থাকাটা আমার মতো অনেকের কাছে নেশার মতো হয়ে গেছে। এভাবে সব মিলিয়ে বলা চলে, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের চাপে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রাজধানী ঢাকার। এদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখার কথা বলা হয়েছে। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। কিন্তু ঢাকায় জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে বসবাস করে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন এবং ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন।

ঢাকায় এত ভিড়ের রহস্যটা কি এটা সম্পর্কে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আমার সংবাদকে বলেন, মূলত কর্মমুখী মানুষের প্রধান লক্ষ্যই থাকে কিছু হলে ঢাকায় আসা। এর যৌক্তিকতাও রয়েছে বাস্তবতা অনুযায়ী। কারণ ঢাকার মতো এমন কর্মসংস্থান কোথাও নেই। তিনি বলেন, শুধু সাধারণ মানুষ না,সরকারি-বেসরকারি, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী সবার উদ্দেশ্য থাকে ঢাকাকেন্দ্রিক বেড়ে ওঠা। মূলত এ কারণেই ঢাকা ধারণক্ষমতার চেয়ে ১২ গুণ বেশি জনসংখ্যা নিয়ে চলছে।

ঢাকা থেকে জনসংখ্যা সরানো বা অন্য কোনো পরিকল্পনা করে বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা নিয়ে জানতে চাইলে এ (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক বলেন, জনসংখ্যা সরানো বা কোনো কর্মসংস্থান কমানো তো কঠিন ব্যাপার, তবে নতুন আর কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠুক সে ব্যাপারে সরকারের কঠোর থাকতে হবে।

ঢাকায় খোলামেলা আলো, বাতাসপূর্ণ জায়গার স্বল্পতা কি বাড়ানো যেতে পারে, এ সম্পর্কে আদিল খান বলেন, এটা ব্যাপারে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানো তো দূরের কথা, যেগুলো আছে সেগুলোও টিকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। এ জন্য পলিসি পর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। আদিল খান বলেন, এখনো ঢাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে, যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে। তিনি বলেন, ঢাকা যে সব যন্ত্রণা এবং বাসযোগ্যতা হারিয়েছে তা সরকারও জানে, আবার নীতি-নির্ধারকরাও জানে কিন্তু তাদের কোনো পদক্ষেপ নেই এটাই সমস্যা এবং এটাকে বিকেন্দ্রীকরণ করার জন্য যে উদ্যোগ নেয়া দরকার তারও অভাব রয়েছে। তবে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যেমন সামপ্রতিক সময়ে দুইটি বড় ইকোনমিক জোন তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন এলাকার সাথে সংযোগস্থল তৈরির জন্য বড় বড় হাইওয়ে প্রজেক্ট তৈরি করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, রাজউক ঢাকা শহরকে চাপমুক্ত করার জন্য স্যাটেলাইট টাউনশিপ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। এবং প্রত্যেকটি স্যাটেলাইট টাউন রিং রোডের মাধ্যমে সংযোগ হবে। শুধুমাত্র এই প্রকল্পে আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে না, আবাসনের পাশাপাশি মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য দূষণমুক্ত শিল্প, পাইকারি বাজার, ওয়ার হাউস, কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণের সুযোগ থাকবে। যার মাধ্যমে বিদ্যমান শহর অনেকটা  চাপমুক্ত হবে এবং মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে রাজউক কেরানীগঞ্জ ও সাভার এলাকায় প্রকল্প গ্রহণের জন্য সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ প্রকল্প শেষ হতে কতদিন সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে আশরাফুল ইসলাম বলেন, সমীক্ষা কার্যক্রম শেষ হয়েছে কিন্তু পুরো প্রকল্প শেষ হতে পাঁচ বছর সময় লাগবে।