ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ

মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে ‘ভূমিকম্প’

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২৩, ১২:১৭ এএম
মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে ‘ভূমিকম্প’
  • মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত সরাসরি প্রভাব পড়েছে তেলের বাজারে
  • ১৯৫৩ সালের পর বড়মাত্রার যুদ্ধ আল-আকসা অঞ্চলে
  • বাংলাদেশের আরও শক্ত অবস্থান চায় ফিলিস্তিন
  • গাজায় সোয়া চার লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত
  • সংঘাত বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশের
  • বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভ, মসজিদে দোয়া

ইসরাইলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের মধ্যকার যুদ্ধকে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির জন্য ‘ভূমিকম্প’ বলে আখ্যায়িত করেছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মধ্যপ্রাচ্য ও কেন্দ্রীয় এশিয়া শাখার প্রধান নির্বাহী জিহাদ আজৌর। গতকাল শুক্রবার মরক্কোর রাজধানী রাবাতে আইএমএফ এশিয়া ও আফ্রিকা শাখার সম্মেলন শুরু হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও কেন্দ্রীয় এশিয়া শাখার প্রতিনিধি হিসেবে এই সম্মেলনে রয়েছেন জিহাদ আজৌরও। সম্মেলনে এক প্যানেল আলোচনায় আইএমএফের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তার অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের স্বল্পোন্নত অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিন দিন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে, কারণ এখানে এখনো অনেক মৌলিক প্রশ্ন বা সমস্যা রয়ে গেছে— যেগুলোর মীমাংসা হয়নি।’

‘এই সপ্তাহের শুরু হতে না হতেই তেলের দাম পাঁচ ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে— বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে যে সংঘাত চলছে, তার সরাসরি প্রভাব পড়েছে তেলের বাজারে। এ ব্যাপারটি খুবই চ্যালেঞ্জিং মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির জন্য। কারণ তেলের বাজার যে মাত্রায় ও গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে, অন্যান্য পণ্য ও পরিষেবার বাজারের ক্ষেত্রে তেমন ঘটছে না। মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে এই সংঘাতের যে স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদি প্রভাব পড়বে, তা অনেক বড় এটি রীতিমতো একটি ভূমিকম্প।’ আইএমএফের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, তেলের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে স্বর্ণের দামও; আর এই দুই পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আরও শক্তিশালী হচ্ছে ডলার। এই যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, সে ক্ষেত্রে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়া শুরু করবে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছেন জিহাদ আজৌর। দুই বছর ধরে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি শেষে ৭ অক্টোবর শনিবার ভোররাত থেকে দক্ষিণ ও মধ্য ইসরাইলের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে একের পর এক রকেট ছোড়া শুরু করে গাজা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাস। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ এবং হামাসের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সূর্যের আলো পুরোপুরি ফোটার আগেই তিন হাজারেরও বেশি রকেট ছোড়া হয়েছিল ইসরাইলের বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে।

কাছাকাছি সময়ে মোটরচালিত প্যারাগ্লাইডারে চেপে হামাসের বেশ কয়েকজন যোদ্ধা সীমান্ত পেরিয়ে ইসরাইলের সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডের কার্যালয়ে গিয়ে সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের বন্দি ও জিম্মি করার পাশাপাশি ওই কমান্ডের সঙ্গে সেনাবাহিনীর মূল কমান্ড ও অন্যান্য শাখার কার্যালয়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মোটরসাইকেল ও জিপে করে সীমান্ত পেরিয়ে ইসরাইলে প্রবেশ করেন হামাসের আরও কয়েকশ যোদ্ধা। গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতি ও পূর্বপ্রস্তুতি না থাকার কারণে হামাসের হামলার পর প্রথম দিকে খানিকটা অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিল ইসরাইল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধে পূর্ণ শক্তিতে ফিরে আসে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী-আইডিএফ। ১৯৫৩ সালের পর এই প্রথম এত বড় মাত্রার যুদ্ধ হচ্ছে আল-আকসা অঞ্চলে। ইসরাইলের সরকার ইতোমধ্যে হামাসকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। গত ছয় দিনের যুদ্ধে ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন দুই হাজার আট শতাধিক মানুষ। এই নিহতদের মধ্যে ইসরাইলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিকের সংখ্যা এক হাজার তিন শতাধিক এবং গাজার ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা এক হাজার ৫৩৭ জন। দুই অঞ্চলের সামরিক সদস্যদের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু, নারী ও বেসামরিক লোকজনও রয়েছেন নিহতদের এ তালিকায়।

এদিকে, ফিলিস্তিনে ইসরাইলের হামলা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংঘাত ও  শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে সংলাপ এবং কূটনীতির মাধ্যমে এই সংকটের স্থায়ী সমাধান আশা করছে বাংলাদেশ। এদিকে ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে ঢাকায় বিভিন্ন সংগঠন সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে। তবে চলমান সংঘাতে বাংলাদেশের আরও জোরালো ও শক্ত অবস্থান চায় ফিলিস্তিন। ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান বাংলাদেশের কাছে আরও জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন। 

শক্ত অবস্থান চায় ফিলিস্তিন :  ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই  রামাদান বলেছেন,  ফিলিস্তিনের এই সংকটের সময়ে  টাকা নয়, আমরা পূর্ণ সমর্থন চাই। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে ফিলিস্তিনকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে ফিলিস্তিনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অনুধাবন করা জরুরি। এটি অর্থনৈতিক সহায়তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে অর্থ নয়, চাই সহমর্মিতা। ’ তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিন এখন শুধু ইসরাইল নয়, পশ্চিমা আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। সেখানকার মানুষজন এক মানবতাহীন জীবনযাপন করছে। বিদ্যুৎ, পানি, খাবার, চিকিৎসা কোনো কিছুই সেখানে আর পর্যাপ্ত নেই। পুরো ফিলিস্তিনজুড়ে মানবতার সংকট চলছে। ফিলিস্তিনের গাজা এখন এক মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত হয়েছে। মরদেহ রাখারও জায়গা হচ্ছে না মর্গগুলোতে। আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা সব সময় ফিলিস্তিনের নাগরিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে এই সংকটের সময় আমরা আরও জোরালো ও শক্ত ভূমিকা প্রত্যাশা করি। ঢাকায় ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার ১৫টি মিশন রয়েছে। এসব দেশের রাষ্ট্রদূত ও চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন ঢাকার ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত। ফিলিস্তিনকে সমর্থন জানিয়ে ইরান, ইরাক, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, কাতারসহ বাংলাদেশে অবস্থিত ওআইসির সদস্যভুক্ত দেশের রাষ্ট্রদূতরা ফিলিস্তিন দূতাবাসে গিয়ে ইতোমধ্যেই  সংহতি প্রকাশও করেছেন। 

সংঘাত বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশের :  ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান সশস্ত্র সংঘাত দ্রুত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।  পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সংঘাত ও সহিংসতায় কোনো পক্ষই লাভবান হবে না। আমরা ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি উভয়কেই সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের জন্য আহ্বান জানাই। বাংলাদেশ সংঘাত ও  শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অনুরোধ করেছে।  শুধুমাত্র সংলাপ এবং কূটনীতি ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের স্থায়ী সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং এই লক্ষ্যে কাজ করার জন্য সব পক্ষকে আহ্বান জানায় বাংলাদেশ। 
বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভ, মসজিদে দোয়া : ফিলিস্তিনে ইসরাইলি হামলা বন্ধে গত কদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীতে ফিলিস্তিনে হামলার প্রতিবাদে বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভ করেছে। একইসঙ্গে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া শুক্রবার জুমার নামাজের মোনাজাতে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের জন্য দোয়া করা হয়।

এদিকে জাতিসংঘ বলেছে, হামাসের আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবে ইসরাইলি বোমা হামলার পর গাজা উপত্যকায় চার লাখ ২৩ হাজারের বেশি মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা ওসিএইচএ গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার দিনের শেষ পর্যন্ত গাজায় বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যা ৮৪ হাজার ৪৪৪ থেকে বেড়ে চার লাখ ২৩ হাজার ৩৭৮ জনে পৌঁছেছে। হামাসের গত শনিবারের হামলার জবাবে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় ব্যাপক হামলা চালানোর ঘোষণা দেয়। হামাস যোদ্ধাদের হামলায় ১২০০ ইসরাইলি মারা যায় এবং প্রায় ১৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে আসে। হামাসের হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরাইল ২৩ লাখ লোকের একটি ঘনবসতিপূর্ণ ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজায় নির্বিচারে বিমান ও কামানের গোলা হামলা চালিয়ে গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। এতে ভবনগুলো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ওই নির্বিচার হামলা চালিয়ে ইসরাইল এক হাজার ৪০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। এদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। ইসরাইল ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে স্থল অভিযান শুরু করেছে। 

ওসিএইচএ বলেছে, ‘আকাশ, সমুদ্র এবং স্থল থেকে ভারী ইসরাইলি বোমাবর্ষণ প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রয়েছে।  ওসিএইচএ জানায়, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একাধিক আবাসিক ভবন ধ্বংস করা হয়েছে।’ এতে বলা হয়েছে, বাস্তুচ্যুতদের দুই-তৃতীয়াংশ দুই লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষ ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সমর্থনকারী জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ পরিচালিত স্কুলে আশ্রয় চেয়েছে। আরও প্রায় ২৭ হাজার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পরিচালিত স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে এক লাখ ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছে এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে।  জাতিসংঘের সংস্থাটি ইসরাইল হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বেসামরিক অবকাঠামোর উল্লেখযোগ্য ধ্বংসের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।