রাজধানী ঢাকাতে মেট্রোরেলে প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ হাজার মানুষ চলাচল করে। ছুটির দিনগুলোতে এই সংখ্যা বেড়ে প্রায় এক লাখে দাঁড়ায়। মেট্রোরেলে যাতায়াত করছেন এমন ৬০ শতাংশ যাত্রী আগে গণপরিবহন ব্যবহার করেছেন। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, ব্যক্তিগত গাড়ির যাত্রীরা এখনো খুব বেশি মেট্রোরেলমুখী হননি। মাত্র ৪ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ির যাত্রী মেট্রোতে চড়ছেন। যদি ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে ৬০ শতাংশ যাত্রী করা যায় তাহলে রাস্তার যানজট কমে যাবে। তবে উত্তরা থেতে মতিঝিল পর্যন্ত নিচের রাস্তায় তুলনামূলক কম যাত্রী চলছে। মেট্রোরেলের পেছনে সবচেয়ে বড় খরচ হলো বিদ্যুৎ। প্রতিদিন পরিবহনে যে পরিমাণ খরচ হয়, তার ৫০ শতাংশ হচ্ছে বিদ্যুতে। সে ক্ষেত্রে মেট্রোরেলের জন্য বিকল্প কিছু ভাবতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কিছু মেট্রোরেলের ৭০ শতাংশ আসে সৌরশক্তি থেকে। কিভাবে বিদ্যুতের খরচ কমানোর জন্য চিন্তা করতে হবে। নয়তো ভাড়া বেশি হওয়ার কারণে যাত্রীর সংখ্যা কমে যেতে পারে।
মেট্রোরেল নিয়ে বুয়েটের এক জরিপে দেখা যায়, মেট্রোরেলের যাত্রীদের ৫৯ দশমিক ৪১ শতাংশ আগে যাতায়াতের জন্য গণপরিবহন ব্যবহার করতেন। জরিপে অংশ নেয়া ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ যাত্রী মেট্রোরেল চালুর আগে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ছয় দশমিক ৮০ শতাংশের বাহন ছিল মোটরসাইকেল, রিকশার যাত্রীর ছিলেন ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া চার দশমিক ৫১ শতাংশ প্রাইভেটকার, ছয় দশমিক শূন্য আট শতাংশ রাইড শেয়ারিং সেবায় প্রাইভেটকার বা মোটরসাইকেল এবং ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ যাত্রী অন্যান্য যানবাহন ব্যবহার করতেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ নিজেদের সময় বাঁচাতে গণপরিবহন ছেড়ে মেট্রোতে চড়া শুরু করেছে। সরকার চেয়েছিল মেট্রোরেলের মাধ্যমে যানবাহনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি ও অযান্ত্রিক গাড়ি থেকে যাত্রীরা মেট্রোরেলে চলে আসবে। এগুলোই হচ্ছে যানজটের অন্যতম কারণ। এই সমস্ত গাড়ি সড়কের প্রায় ৭০ শতাংশ জায়গা দখল করে মাত্র ৭ শতাংশ যাত্রী বহন করছে। তবে মেট্রোরেল ব্যবহার করলেও তাদের অধিকাংশ হচ্ছে গণপরিবহন ব্যবহার করা যাত্রী। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করা যাত্রীরা এখনো তেমনভাবে সাড়া দেননি। ব্যক্তিগত গাড়ি না কমাতে পারলে যানজটের ভোগান্তি কিছুতেই কমানো সম্ভব নয়।
সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, আমাদের চলাচলে সুবিধা হলেও ভাড়ার পরিমাণ অনেক বেশি। এখন আমরা দুই ঘণ্টার রাস্তা মাত্র ৩০ মিনিটে চলে যেতে পারি। তাবে মাস শেষে আমাদের বেতন থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে যাচ্ছে। ফলে আমাদের পরিবারসহ সারা মাসের খচর চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, ব্যক্তিগত গাড়ির যাত্রীদের মেট্রোরেলমুখী করার মাধ্যমে েশতাংশান্তি কমানোই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু ব্যক্তিগত গাড়ির চেয়ে গণপরিবহনের যাত্রীরা বেশি চলাচল করছেন। তবে ব্যক্তিগত গাড়ির যাত্রীদের মেট্রোমুখী করতে হলে কিছু বিষয়ের সংস্কার করা জরুরি। সে ক্ষেত্রে মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোতে ভালো মানের পার্কিং ও ফুটপাতসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মেট্রোরেলগুলোতে ফুটপাতের নেটওয়ার্কগুলো অনেক বেশি উন্নতমানের। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের মেট্রোরেলগুলোতে বাইসাইকেলের ব্যবস্থা রয়েছে। তাই ফিডার সার্ভিস ও বিকল্প ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যাত্রী ধরে রাখার জন্য আরও উন্নত মানের চিন্তা করতে হবে। আমাদের দেশেও ফিডার সার্ভিসকে শক্তিশালী করতে হবে।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান আরও বলেন, ব্যক্তিগত গাড়ি ও নিচের যাত্রীদের যদি উপরে তোলা যায় তাহলে যানজটের েশতাংশান্তি অনেকটা কমে যাবে। তখন নিচের রাস্তাতে সিটিং বাসগুলোকে ঢেলে সাজানো যাবে। ভালো মানের সুবিধা না থাকলে ব্যক্তিগত গাড়ির যাত্রীদের মেট্রোরেলে আকৃষ্ট করা যাবে না। একবিংশ শতাব্দীতে মেট্রোরেল করা হয় মূলত করিডোর-ভিত্তিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তুলনায় আমাদের দেশে মেট্রোরেলের ভাড়া বেশি। মেট্রোরেলের প্রতি কিলোমিটারে খচর প্রায় আড়াই থেকে তিনগুণ বেশি। মানুষকে মেট্রোমুখী করতে হলে ভাড়া গণবান্ধব করতে হবে। মেট্রো স্টেশনকে কেন্দ্র করে আয়ের উৎস বের করতে হবে। একজন মানুষ যে পরিমাণ আয় করে তার ২০ শতাংশের বেশি যাতায়াতের পেছনে খরচ করে। অথচ একটি শহরের জন্য এটি কখনোই কাম্য নয়। মেট্রো হওয়ার আগেই মানুষ ২০ শতাংশ খরচ করত। এখনো যদি একই খরচ করতে হয়ে তাহলে বুঝতে হবে টেকসই উন্নয়ন হয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ আমার সংবাদকে বলেন, ‘মেট্রোরেল চালু হওয়ার ফলে গণপরিবহনে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়েনি। রাজধানী ঢাকাতে প্রতিদিন গণপরিবহনে প্রায় চার কোটি যাত্রী চলাচল করেন। তার মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ মেট্রোরেলে চড়ছেন। সুতরাং ঢাকার গণপরিবহনে মেট্রোরেলের ফলে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। তবে সবগুলো মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ার পর কিছুটা বাড়তে পারে। তখনও মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ যাত্রী বহন করতে পারবে। বাকি ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ যাত্রীকে চলতে হবে গণপরিবহনে। ছয়টি মেট্রোরেলের মধ্যে মাত্র একটি চালু হয়েছে তাই এতে প্রভাব পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। মতিঝিল থেকে উত্তরা রুটের যাত্রীর ৫ শতাংশও মেট্রোরেল বহন করতে পারছে না। দিল্লির মেট্রোরেলের সাতটি স্টেশনের ভাড়া হচ্ছে মাত্র ২০ টাকা। অথচ আমাদের দেশে সাতটি স্টেশনের ভাড়া ৮০ টাকা। মেট্রোকে আমরা গণপরিবহন মনে করতে পারি না। এটি একটি বিশেষ শ্রেণির পরিবহন বলে মনে করি। এখানে গণমানুষ উঠার সামর্থ্য নেই। কারণ এটির ভাড়া তুলনামূলক বেশি। পেশাজীবী মানুষদের জন্য কষ্টকর হয়ে যায়। মিরপুর থেকে মতিঝিলে বাসে আসতে খরচ হয় মাত্র ২৫ টাকা। আর মেট্রোরেলে একই পথ আসতে খরচ হয় ৭০ টাকা।