- ঈদ, পূজা ও বিশেষ আনন্দ উৎসবের ভাবনায় বারবার পিছপা
- অপরিকল্পিত ঘোষণায় হরতাল-অবরোধ অসহযোগেও সাড়া মেলেনি
- ছয় মাসে ৮২ মামলায় আসামি প্রায় লাখো নেতাকর্মী। সাজা ১২৭৩ জনের
আর মাত্র সাতদিন পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপিসহ ভোটে যায়নি সরকারবিরোধী ৬০টি রাজনৈতিক দল। হরতাল, অবরোধ ও গণসংসংযোগ কর্মসূচি দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনে রয়েছে দলটি। তবে এখনো ঘরে কোনো ফসল তুলতে পারেনি দেড় যুগের বেশি ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। গত বছরের শুরুতেই সরকার পতনে এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ শীর্ষ নেতা বলেছিলেন ঈদের পর চূড়ান্ত আন্দোলনে নামবেন। এরপর বলা হয়, পূজা শেষে বড় আন্দোলন। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার সমাবেশে হামলার পর দলটির শীর্ষ প্রায় শতাধিক নেতা আটক হয়। ঢাকাসহ সারা দেশে মাঠপর্যায়ের নেতারা আত্মগোপনে চলে যায়। এরপর শুরু হয় হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলন।
সর্বশেষ গতকাল বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আবারও দুদিনের গণসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে জানান, বছরের শুরু ও শেষ মানুষের আনন্দের দিন। এ দুদিন মানুষের ভালো সময় পার হলে তারা চূড়ান্ত পথে হাঁটবেন। ২০২৩ এ বছরটিতে বারবার কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিলেও নমনীয় কর্মসূচির বেশি কিছু করতে পারেনি বিএনপি। অপরিল্পিত হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগ, পদযাত্রা, অবস্থান কর্মসূচি, গণমিছিল ও রোডমার্চ, মিডিয়া ব্রিফিং, মানববন্ধন, বিবৃতি আর কিছু সভা-সমাবেশেই ঘুরপাক খেয়েছে দলটি। সেজন্য বিদায়ী বছরও তাদের কেটেছে ‘নিষ্ফল’ মাঠপর্যায় থেকে এমনি দাবি উঠেছে। তবে দলটির হাইকমান্ড বলছে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী বছরের প্রথম সপ্তাহে পাঁচ দিনের শর্টটাইমের আন্দোলন করবেন। ওই আন্দোলন কিভাবে হবে, মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে কোনো ধারণা নেই বলেই দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি।
আন্দোলনের হুমকিতেই বছর শুরু : গত ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে এক দফার আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়। সেই সমাবেশ থেকে সংসদ বিলুপ্ত, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিসহ ১০ দফা ঘোষণা করে দলটি। এরপর ২০২৩ সালকে নির্বাচনি বছর ধরে জানুয়ারি মাস থেকেই সরকারের পতনের আন্দোলনে সরব হয় বিএনপি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা নিয়ে চলে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় নির্বাচনের বছর খানেক আগে ২০২২ সালের অক্টোবরে সারা দেশে সাংগঠনিক বিভাগগুলোতে ধারাবাহিক সমাবেশ কর্মসূচি করে বিএনপি, যা শেষ হয় ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগ মাঠের সমাবেশের মধ্য দিয়ে। এরপর রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফাসহ বারবার দফায় কাটে লম্বা সময়। গঠন করা হয় ৩৬ দলের রাজনৈতিক জোট। শুরু হয় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগ থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে পদযাত্রা, অবস্থান কর্মসূচি, গণমিছিল ও রোড মার্চ কর্মসূচি। মূলত বছরজুড়েই আন্দোলনমুখী ছিল বিএনপিসহ সমমনা জোটগুলো। আন্দোলনের পাশাপাশি সারাবছরই নেতাকর্মীদের মাঝে ছিল গ্রেপ্তার ও সাজা আতঙ্ক।
শেষবেলায় সংঘাতে আত্মগোপনে : গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় দলটির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে কঠোর হয়ে ওঠে সরকার। গ্রেপ্তার করা হয় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির বেশ কজন সিনিয়র নেতাকে। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যায় মাঠে সক্রিয় থাকা দলটির বহু নেতাকর্মী। সরকার পতনের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে শেষপর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপিসহ অন্তত ৬০টি দল। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে গোপনীয় স্থান থেকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এছাড়া তিনি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল করে উত্তাপ ছড়ান।
আদালতের বারান্দায় বেশি সময় পার : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিদায়ী বছরে উত্তপ্ত ছিল রাজনৈতিক অঙ্গন। রাজনীতির সেই উত্তাপের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে আদালতে। বছরজুড়ে আদালত অঙ্গনে আলোচনায় ছিল বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার। এছাড়াও দুদকের মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে সাজা দেয়া হয় এ বছরই। সেই সঙ্গে নাইকো মামলায় খালেদা জিয়ার বিচারও শুরু হয়। অন্যদিকে, বছরের শেষদিকে এসে গত পনের বছরে নাশকতার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় সহস্রাধিক বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আসে কারাদণ্ডের রায়। দণ্ডিতের তালিকায় দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও রয়েছেন। আদালত থেকে রিমান্ড ও সাজার ঘটনায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
ছয় মাসে ৮২ মামলায় আসামি প্রায় লাখো নেতাকর্মী : গত ২৮ ও ২৯ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে দলটির ২৭ হাজার ২০১ জন নেতাকর্মী গ্রেপ্তার। মামলার সংখ্যা ১১ হাজার ৮টি। আসামী ৯৯ হাজার ৩৮১ জন। আহত ৯ হাজার ৩৯৯ জন। মৃত্যু ২৭ জন (সাংবাদিক একজনসহ) সাজা ৮২টি মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশসহ এক হাজার ২৭৩ জনের।
গয়েশ্বর রক্তাক্ত : গত ২৯ জুলাই রাজধানীর ধোলাইখালে ঢাকার প্রবেশমুখে কর্মসূচিতে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় আহত হন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। নেতাকর্মীদের অভিযোগ পুলিশ গয়েশ্বরকে রাস্তায় ফেলে সাপের মতো পিটিয়েছে।
দলীয় কর্মসূচিতে এমপিদের অনুপস্থিতি : বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে নেতাকর্মীদের খুব একটা যোগাযোগ নেই বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ বছর দলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতেও তাদের তেমন একটা দেখা যায়নি। সংসদে সরকারি সুবিধা নিয়ে সরকারবিরোধী বক্তব্যে সরব থাকাতেই তাদের রাজনৈতিক চর্চা সীমাবদ্ধ বলে অভিযোগ তুলেছেন অনেক নেতাকর্মী।
নির্বাচনে যেতে চাপ : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদধারীসহ কিছু নেতা দল ছেড়ে নির্বাচনে অংশ নেন। সাংগঠনিক ও ভোটের মাঠে এসব নেতার তেমন গুরুত্ব না থাকলেও দলের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তম এবং দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সাথী বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীককে শেষ পর্যন্ত জোট ছেড়ে চলে যাওয়া আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। বহিষ্কৃত নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমূর আলম খন্দকার তৃণমূল বিএনপিতে গিয়ে আলোচনার জন্ম দেন। যদিও সরকারি দলের তরফে বিএনপির অনেক নেতা ভোটে যাবেন, এমনটা বারবার বলা হয়েছিল।
হাসপাতালেই খালেদা জিয়া : বছরজুড়েই দলের চেয়ারপারসন অসুস্থ খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ইস্যুটিও ছিল বিএনপির আলোচনার কেন্দ্রে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে কারামুক্ত খালেদা জিয়া বর্তমানে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কখনো কেবিনে আবার কখনো আইসিইউতে রেখে তার চিকিৎসা চলছে। এরই মধ্যে গত ২৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় এসে ২৬ অক্টোবর খালেদা জিয়ার অস্ত্রোপচার করেন। বছরের শেষ দিকে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতির খবর আসে। তবে, এই মুহূর্তে বাসায় ফিরতে পারছেন না তিনি। থাকতে হচ্ছে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, অবশ্যই বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলনে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য নতুন সূর্যের উদয় হবে। বিএনপি মানুষের অধিকার আদায়ে রাজপথে আছে। জনগণের হারানো অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে সারাবছর বিএনপির নেতাকর্মীরা সক্রিয় ছিল। তারা তাদের লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে পিছপা হননি। অবিচলভাবে জুলুম-অত্যাচার সহ্য করে চলমান আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে এবং যতদিন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারবে ততদিন তা অব্যাহত থাকবে।