অপরিশোধিত জ্বালানির দাম

বিশ্ববাজারে কমলেও সমন্বয় নেই দেশে

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪, ১২:৩৫ এএম
বিশ্ববাজারে কমলেও সমন্বয় নেই দেশে

বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও দেশে কমে না— এটি অন্যায্য 
—ম. তামিম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েট অধ্যাপক

যেভাবে মূল্য নির্ধারণ করা হয়, এতে প্রচুর লুণ্ঠনমূলক মূল্য সংযোজন হয় 
—এম শামসুল আলম, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। দুই বছর আগে শুরু হওয়া এই সংঘাতের প্রভাব পড়ে বিশ্বব্যাপী। হু হু করে বেড়ে যায় জ্বালানি তেল, গ্যাসের দাম। সরকারের তরফ থেকে তখন বলা হয়েছিলো বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে দেশে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশে আবার সমন্বয় করা হবে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাতে কয়েক দফা দাম বাড়লেও কমানো হয়নি জ্বালানির দাম। আগামী মাসে ফের জ্বালানির তেলের দাম সমন্বয়ের কথা ভাবছে সরকার।  

বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্নমুখী হয়ে উঠেছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম। এরই মধ্যে পণ্যটির মূল্য নেমে এসেছে এক বছরের সর্বনিম্নে। বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাসের কারণে এর মূল্য কমছে বলে বাজার বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামা অব্যাহত থাকলেও এবারই ডিসেম্বরে বড় দরপতন হলো। চলতি মাসেও কমেছে জ্বালানি তেলের দাম। এ দর আরো নিম্নমুখী হওয়ার কথা জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

চলতি মাসে মার্কিন চাকারি বিষয়ক পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে আসার পর বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে শিগগিরই সুদ হার কমছে না, এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে বিশ্ববাজারে ফের কমে যেতে পারে জ্বালানি তেলের দাম। এতে গত ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ২ শতাংশ পড়ে গেছে। এর আগের সপ্তাহে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের উভয় বেঞ্চমার্কের দাম কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, শুক্রবার ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১ দশমিক ৩৭ ডলার বা ১ দশমিক ৭ শতাংশ কমে ব্যারেলপ্রতি দাঁড়িয়েছে ৭৭ দশমিক ৩৩ ডলার। ইউএস ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুডের দাম ১ দশমিক ৫৪ ডলার বা ২ শতাংশ কমে প্রতি ব্যারেল ঠেকেছে ৭২ দশমিক ২৮ ডলারে। কোভিড পরবর্তী সময় ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এক পর্যায়ে দর ঊর্ধ্বমুখী থাকায় ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১৩০ ডলারের কাছাকাছি চলে যায়। তথ্যসেবা ও পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে ডব্লিউটিআইয়ের গড় মূল্য গত অক্টোবর পর্যন্ত ছিল ৭৮ ডলার ২২ সেন্ট আর ব্রেন্টের ৮২ ডলার ৭৯ সেন্ট।

এদিকে বিশ্ববাজারে ব্যাপক হারে দরপতন হলেও দেশে এখনই তা সমন্বয় হচ্ছে না বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনকারী সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কর্মকর্তারা। বিষয়টি এখন কেবল পর্যবেক্ষণ করা হবে বলে জানান তারা। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বরাবরই অস্থিতিশীল। নিম্নমুখী দাম থাকলে কখন এটি ঊর্ধ্বমুখী হবে সেটি বলা যাবে না। ফলে কয়েক মাস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যা বিপিসি সার্বক্ষণিক করছে। এ সময় দাম স্থিতিশীল থাকলে জ্বালানি বিভাগকে অবহিত করা হবে। এরপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম। বেড়েছে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ। জনদুর্ভোগ বেড়েছে চরম পর্যায়ে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। এদিকে গত বছর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, এখন থেকে বিদ্যুতে আর ভর্তুকি দেয়া হবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশের বাজারেও বাড়ানো হবে। সরকার যদি এটাই নীতি হিসেবে নিয়ে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম কম ছিল, তখন কেন দেশের বাজারে ইচ্ছেমতো বাড়ানো হলো— প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের। এদিকে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, এখনো বিপিসি লোকসান গুনছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেই দেশে বাড়ানো হয়। কিন্তু দাম কমলেও প্রভাব পড়ে না দেশে। বিশ্বেবাজারে এখন জ্বালানি তেলের দাম অনেকাংশে কমেছে, কিন্তু দেশে এখনো দাম সমন্বয় না করা অন্যায্য। সরকারের উচিত, বিশ্ববাজার অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম কমানো এবং এর প্রভাবে গণপরিবহন ও যেসব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, তা কমিয়ে জনসাধারণের জীবনযাত্রায় অব্যাহত চাপ কমানোর ব্যবস্থা নেয়া। তবে অনেকেই আশঙ্কা করছে ফের দাম বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে বলেন, যেই যুক্তিতে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল, সেই যুক্তি এখন আর নেই। এর পরও দাম কমানো হচ্ছে না। আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। যদি সরকার মনে করে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল আগের সেই দামে ফিরে গেলে দেশে দাম কমাবে, তাহলে এটি অন্যায় হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণের লক্ষ্যে চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি কার্যকর করার পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চূড়ান্ত ফর্মুলার অনুমোদন দেয়ার পর তা বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট মাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমেছে, আবার বেড়েছেও। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে। 

এ অবস্থায় সরকারের পরিকল্পনা ছিল চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করা। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও আন্তর্জাতিক বাজারের অনিশ্চিত পরিস্থিতি বিবেচনায় সেটি করা হয়নি। এর ফলে বিপিসি গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে দেশে কমে না এটি অন্যায্য। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে দেশেও দেশের বাজারে কমা উচিত। এ বিষয়ে একটি তহবিল গঠন করে এই মুনাফা সেখানে রেখে দিতে হবে। এদিকে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব মনে করে, তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ না থাকায় গণশুনানিকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে জ্বালানির দাম নির্ধারণের সব পদ্ধতিই গ্রাহক স্বার্থবিরোধী। 

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, যেভাবে তারা মূল্য নির্ধারণ করে, সেখানে প্রচুর পরিমাণে লুণ্ঠনমূলক মূল্যের সংযোজন হয়। সেই পেন্ডোরার বক্স তো কখনই খোলা হলো না। সুতরাং, এটি দিয়ে জনস্বার্থ রক্ষা করা যাবে না; বরং জনগণকে লুণ্ঠন করার আরও একটি মাত্রা যোগ হবে।