- রোজাতেও যানজট ভোগান্তিতে রাজধানীবাসী
- ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় যাত্রীদের
- যানজট নিরসনে ব্যর্থ সরকারি সংস্থাগুলো
- ডিএমপির উদ্যোগ কাজে আসছে না
- সরকারি মেগা প্রকল্পেও কমছে না দুর্ভোগ
সড়কের সক্ষমতার চেয়ে গাড়ি বেশি হওয়ায় যানজট বাড়ছে
— অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান, পরিচালক এআরআই, বুয়েট
ব্যক্তিগত গাড়ি কমিয়ে মানসম্মত গণপরিবহন চালু না হলে যানজট নিরসন সম্ভব নয়
—ড. আদিল মোহাম্মদ খান, নগর পরিকল্পনাবিদ
রাজধানীতে যানজটের ভোগান্তি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হলেও রোজায় এর তীব্রতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন দুপুর শেষ না হতেই শুরু যানজটের তীব্রতা। বিকাল গড়াতেই বাড়তে থাকে এর মাত্রা। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের। একদিকে গরম আর অন্যদিকে যানজটের কারণে রোজা রেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন নগরবাসী। সাধারণ মানুষ ইচ্ছে করলেও সময় মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। এতে করে রোজা রেখে প্রচণ্ড গরমে গাড়িতে বসে থাকতে হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে না পেরে দুর্ভোগে পড়ছেন এসব ঘরমুখী মানুষ। ফলে বহু মানুষকে গাড়িতেই ইফতার করতে হয়। যানজটের ভোগান্তি থেকে মুক্তি দিতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা ব্যর্থ হচ্ছে সরকারি সংস্থাগুলো। তবে এর জন্য হাতের ইশারা ট্রাফিক পদ্ধতিকে দায়ী করছেন বিশষজ্ঞরা। কারণ ট্রাফিক পদ্ধতির যথাযথ প্রয়োগ করতে না পারলে এই সমস্যার সমাধান কখনো হবে বলেও মনে করছেন তারা।
সাদিকুর রহমান প্রতিদিনের মতো অফিস থেকে গত শুক্রবার ইফতার করতে বাসার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছুটা পথ যেতেই তীব্র যানজটে আটকা পড়েন তিনি। অন্য দিন বাসায় সময় মতো পৌঁছাতে পারলেও সেদিন গাড়িতেই ইফতারির সময় হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে কিছু এনে ইফতার করতে হয়েছে। অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই কথাগুলো বলছিলেন তিনি। ঢাকার এই যানজট না কমলে হলে মানুষের ভোগান্তি কিছুতেই শেষ হবে না বলে জানান সাদিকুর।
শুধু সাদিকুর রহমানই নয়, তার মতো এমন অনেক যাত্রী প্রতিনিয়ত গাড়িতে ইফতার করছেন। রোজা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানজটের পরিমাণও বেড়ে চলেছে। রোজায় যানজটের তীব্রতা ঠেকাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উদ্যোগও কাজে আসছে না। বিশেষ করে বিকাল ৩টার পর থেকে ইফতারের আগ পর্যন্ত স্থবির হয়ে পড়ছে ঢাকার সড়ক। দুপুর থেকে শুরু হওয়া যানজট সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। ইফতারের আগ পর্যন্ত যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে।
সরেজমিন গতকাল দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার বিজয় সরণী মোড়, ধানমন্ডি ২৭ ও ৩২, সাইন্সল্যাব মোড়, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, শাহবাগ, ফার্মগেট, গুলিস্তান, পল্টন মোড়, বাংলামোটর, আজিমপুর, কামরাঙ্গীরচর, মগবাজার, বাংলামোটর, কাওরান বাজার, ফার্মগেট, আগারগাঁও, মিরপুর, মালিবাগ, কারওয়ানবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র যানজটের দৃশ্য দেখা গেছে। ব্যক্তিগত, অযান্ত্রিক গাড়ি ও গণপরিহবনের নিয়মবহির্ভূতভাবে চলাচলের কারণে বেশি যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। তবে অধিকাংশ জায়গায় দেখা যায়, ইদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে সবাই কেনাকাটা করতে বিভিন্ন শপিংমলগুলোতে ভিড় জমাচ্ছে। এতে করে আশপাশের সড়কে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।
রাজধানীর পল্টন মোড় থেকে কল্যাণপুরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন ইব্রাহিম। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করে মাত্র সাইন্সল্যাব পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি থাকায় সামনের দিকে কিছুতেই চলছে না। তবে কেন এমনটা হচ্ছে কেউ জানে না। ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার কারণেও এমনটা হতে পারে। যানজট নিরসনে রাজধানীজুড়ে বেশকিছু মেগা প্রকল্প নির্মাণ করা হলেও দেখা মিলছে না যানজটমুক্ত নগরীর। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি। সরকার নানা প্রকল্প ভালো কোনো ফলপ্রসূ হচ্ছে না বলে মনে করছেন নগরবিদরা। এর মধ্যে অন্যতম হলো মেট্রোরেল। তাছাড়া রাজধানীবাসী যেন যানজটের ভোগান্তি থেকে মুক্তি পায় সেজন্য ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করেছে সরকার। যানজট নিরসনে এটিই হচ্ছে সরকার কর্তৃক গৃহীত সবচেয়ে বড় প্রকল্প। অথচ তাতেও তেমন কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এছাড়াও গত দুই দশকে প্রায় ১০টি উড়ালসড়ক ও সমজাতীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা হয় যানজট কমাতে। তবে এর আশানুরূপ ফল পাচ্ছে না রাজধানীবাসী। বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার সড়কে পিক টাইমে চলাচল করা যানবাহনের গড় গতি হচ্ছে চার দশমিক আট কিলোমিটার। যা একজন সাধারণ মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কম। দুই বছর আগেও এই গতি ছিল প্রতি ঘণ্টায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার। কারণ একজন সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে হাঁটলে প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার গতিতে যেতে পারে। ফলে একজন মানুষ ইচ্ছে করলে হেঁটেই গাড়ির আগে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। স্বাভাবিক মনে হলেও বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআইআর) পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ঢাকা অনেক আগেই সড়কের সক্ষমতা থেকে গাড়ির পরিমাণের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। নতুন নতুন গাড়ি নামলেও সড়কের পরিমাণ বাড়ছে না। সড়কের সক্ষমতার চেয়ে গাড়ির সংখ্যা বেশি হওয়ায় যানজটের পরিমাণ বাড়ছে। একজন সুস্থ মানুষ স্বাভাবিকভাবে হাঁটলে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার গতিতে হাঁটতে পারে। হাঁটার গতির চেয়ে পিক আওয়ারে গাড়ির গতি কিছুটা কম। অতিমাত্রার যানজটের পেছনে অনিয়ন্ত্রিত ছোট ছোট যান প্রধান দায়ী। বিআরটিএর এখনই উচিত এসব ছোট যানবাহনের নিবন্ধন দেয়া বন্ধ করা। ট্রাফিক পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অবস্থা আরও ভয়াবহ হতে পারে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, রাজধানী ঢাকার রাস্তার সক্ষমতা যতটুকু তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি গাড়ি চলছে। উড়ালসড়ক ও এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করলেও কাজে আসবে না, যদি পরিবহনের সক্ষমতা না থাকে। এক্ষেত্রে প্রধান কাজ হলো ছোট বাহন কমিয়ে গণপরিবহন বাড়ানো। সবাইকে গণপরিবহনের দিকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা না থাকলে বড় প্রকল্প করে সুফল পাওয়া যাবে না। যানজটের সমস্যা নিরসনে পরিবহনের দিকে নজর দেয়া জরুরি। গণপরিবহনের সমস্যা ও যানজটের কারণে অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে ঝুঁকছেন। সরকার যদিও বলেছে গণপরিবহন ও ফুটপাতে অর্থ ব্যয় করবে কিন্তু তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। রাজধানীজুড়ে মানসম্মত বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করতে পারলে যানজটের সমস্যা নিরসন সম্ভব। বড় প্রকল্প না করে ঢাকার পরিবহনকে ঢেলে সাজানো জরুরি। ঢাকার মতো শহরের জন্য টানেলের মতো প্রকল্প একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প।