কলমানিতে লেনদেন

সুদের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘনে ৩৩ ব্যাংক

জাহাঙ্গীর আলম আনসারী প্রকাশিত: এপ্রিল ৩, ২০২৪, ১২:১৫ এএম
সুদের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘনে ৩৩ ব্যাংক

তদন্ত করে ব্যবস্থা

—মুখপাত্র

  • বারবার নিয়ম লঙ্ঘনে তারল্য সুবিধা বাতিল হতে পারে 

তারল্য সংকটের ধকল সামলাতে তফসিলি ব্যাংক ও ননব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ (এনবিএফআই) নিজেদের মধ্যে কলমানিতে (ওভার নাইট) ধার-দেনা করে। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংক বেঁধে দেয়া সর্বোচ্চ সুদ সীমা ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ মানছে না।

জানা গেছে, ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার ৮১১ কোটি টাকা লেনদেন করেছে ৩৩টি ব্যাংক ও ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সুদের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘনের দায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হয় তবে জরিমানার মুখোমুখী হতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য সুবিধাও বাতিল হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, তারল্য ব্যবস্থাপনা তো ব্যাংকের নিজস্ব বিষয়। তবে আইন নীতিমালা মানতে তো বাধ্য। সবাই যদি ইচ্ছেমতো কলমানি থেকে ইচ্ছামতো রেটে লেনদেন করে তাহলে তো রেট নির্ধারণের দরকার ছিল না। বাজার লাগামছাড়া হবে। শাস্তির আগে তদন্ত করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যাদের বিরুদ্ধে নিয়ম লঙ্ঘনের দায় প্রমাণিত হবে তারাই আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৩টি ব্যাংক বেঁধে দেয়া সর্বোচ্চ ৯ টাকা ৫০ পয়সা সুদের সীমা লঙ্ঘন করে তিন হাজার ১০৫ কোটি টাকা ধার করেছে এবং একই সময়ে দুই হাজার ৬১০ কোটি অন্য ব্যাংককে ধার দিয়েছে। এটা ব্যাংকগুলোর জন্য অনেকটা চিরাচরিত নিয়ম বলা যায়। মূলত বাগড়া দেখা দিয়েছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘনকে কেন্দ্র করে। একইভাবে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ সুদের সীমা লঙ্ঘন করে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ হারে ৯৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ধার করেছে। এ ধরনের লেনদেন ব্যাংকিং নীতিমালার পরিপন্থি হিসেবে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকের মধ্যে জনতা ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা দরে কলমানি মার্কেটে অন্য ব্যাংক থেকে ৪৮১ কোটি টাকা ধার করেছে। আর বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও একই রেটে ৯৫ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। আর বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা দরে ৪৫৯ কোটি টাকা দার দিয়েছে। আর বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ৯ টাকা ৬০ পয়সা রেটে ৩০৪ কোটি ধার দিয়েছে। ব্যাংক সিলং ৯ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ১১৬ টাকা, একই রেটে ব্যাংক আল ফালাহ ১৭৬ কোটি টাকা কলমানিতে ধার দিয়েছে। তবে বেসরকারি সিটি ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ৩০০ টাকা ধার দিয়েছে। কিন্তু এবি ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা দরে ৬০ কোটি টাকা ধার করেছে। মিডল্যান্ড ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা সুদে ২৩৫ কোটি ধার করেছে।

এছাড়া আইএফআইসি ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা রেটে ২০৯ কোটি এবং সিটিজেন ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা সুদহারে ১৮ কোটি টাকা অন্য ব্যাংককে ধার দিয়েছে। ইউসিবি ৯ টাকা ৭৫ পয়সা সুদে ২৯৭ কোটি ধার করলেও ব্যাংকটি ৯ টাকা ৮০ পয়সা রেটে ২৮০ কোটি টাকা অন্য ব্যাংককে ধার দিয়েছে। কিন্তু এনসিসি ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা সুদে ১০৪ কোটি, এনআরবি একই দরে ৭৫ কোটি ধার করেছে।

এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কলমানি হচ্ছে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের টাকা ধার নেয়ার একটি ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় দৈনন্দিন ও স্বল্প মেয়াদে টাকার চাহিদা মেটাতে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে। যেসব ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত তারল্য থাকে, তারাই মূলত ধার দিয়ে এর বিনিময়ে সুদ নেয়। সুদের হার নির্ভর করে কত দিনের জন্য টাকা ধার নেয়া হচ্ছে, তার ওপর। আবার কখনো কখনো চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করেও সুদহার ওঠানামা করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিতে কলমানি দেয়া হয়।’

এদিকে ইস্টার্ন ব্যাংক ৯ টাকা ৬০ পয়সা দরে ১২৩ টাকা, এসবিএসি ব্যাংক একই দরে ১৪৪ কোটি, ঢাকা ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা সুদে ৩৬৪ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক ৯ টাকা ৬০ পয়সা রেটে ৪৫ কোটি টাকা ধার করেছে। এনআরবিসি ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা রেটে ২৫ কোটি ধার দিয়েছে। মধুমতি ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা রেটে ১১৫ টাকা ধার করলেও একই রেটে আবার ৬১ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। সাউথইস্ট ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা সুদে ৬১ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। কিন্তু ব্যাংক এশিয়া ৯ টাকা ৬০ পয়সা রেটে ৮১ কোটি ধার করলেও একই রেটে ৪০ কোটি ধার দিয়েছে। সীমান্ত ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা রেটে ৬৩ কোটি এবং উত্তরা ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা রেটে ৪৬৪ কোটি টাকা বিক্রি করেছে। তবে ওয়ান ব্যাংক ৯ টাকা ৬০ পয়সা রেটে ১০ কোটি, পূবালী ব্যাংক একই রেটে ২৫৫ কোটি, যমুনা ব্যাংক ৯টাকা ৯০ পয়সা দরে ৪৬৬ কোটি, মেঘনা ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পঢসা রেটে ৮৫ কোটি এবং কমিউনিটি ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা সুদে ১০৪ কোটি টাকা ধার করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানা গেছে, গত ২৭ মার্চ কলমানির সুদের হার ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হিসাবে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশের রেকর্ড উঠেছে। ২০১২ সালের পর এটিই কলমানির সর্বোচ্চ সুদহার। ওই বছর কলমানির সুদের ১২ দশমিক ৮২ শতাংশে উঠেছিল সুদহার।

অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আইডিএলসি, ডিবিএইচ, পিএফআইএন, বে লিসিং, বিডি ফাইন্যান্স ও আইসিবি নিয়ম লঙ্ঘনের মাধ্যমে কলমানি মার্কেটে লেনদেন করেছে।