পাঁচ দুর্বল ব্যাংকেই সীমাবদ্ধ থাকছে একীভূতকরণ

জাহাঙ্গীর আলম আনসারী প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০২৪, ০৫:৩৯ পিএম
পাঁচ দুর্বল ব্যাংকেই সীমাবদ্ধ থাকছে একীভূতকরণ
  • বেসিকে কর্মরতরা প্রাইভেট ব্যাংকের সুবিধা পাবেন
  • অনিয়মে জড়িতরা ছাড় পাবেন না

পাঁচটির একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগবে : মুখপাত্র

ঋণ জালিয়াতি ও অব্যবস্থাপনাসহ নানা অনিয়মের কারণে উচ্চ খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি ও তারল্য সংকটের কারণে অতিদুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে না পেরে এগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই একীভূতকরণের তালিকায় ছিল ১০টি দুর্বল ব্যাংক : যথা পদ্মা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, বিডিবিএল, বেসিক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। তবে আপাতত পাঁচটি দুর্বল ব্যাংকেই একীভূতকরণ সীমাবদ্ধ থাকছে। এগুলোর একীভূত করার সব প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো দুর্বল ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেয়া হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক গতকাল সোমবার দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, আপাতত পাঁচটিতেই ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সীমাবদ্ধ থাকবে। পাঁচটি ব্যাংককে অন্য পাঁচটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের সব প্রক্রিয়া শেষ করতে অনেক সময় লাগবে। ব্যাংকগুলোকে যোগ্য অডিট ফার্ম দিয়ে অডিট করাতে হবে। ভালো মানের অডিট ফার্ম খুঁজে পাওয়ারও তো একটা বিষয় আছে। সব মিলিয়ে আপাতত পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককেই অন্য পাঁচটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্য কোনো ব্যাংক এখন একীভূত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এলে আর অনুমতি দেয়া হবে না।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংক সরকারি হলেও একীভূত হওয়ার পর ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সিটি ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পাবেন। তখন এটা আর সরকারি থাকবে না; প্রাইভেট হয়ে যাবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বেসরকারি ব্যাংকের সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম-জালিয়াতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলো সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করাই সমাধান নয়। বর্তমানে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা হচ্ছে সুশাসন। এখানে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। আর যাদের কারণে এতগুলো ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে,  তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংক একীভূতকরণ নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছে। এর কিছু পয়েন্টকে প্রাথমিক অ্যাকশন হিসেবে দেখতে পারেন। নীতিমালা অনুযায়ী দুর্বল ব্যাংকের এমডি, এএমডি ও ডিএমডির চাকরি থাকবে না। পরিচালকরাও পাঁচ বছরের আগে পরিচালক পদ পাবেন না। এগুলো কী এক ধরনের শাস্তি নয়?

যাদের কারণে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের বিষয়ে কোনো তদন্ত হবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, এখানে দুটি বিষয় আছে। প্রথমত, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা। যেহেতু দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ হয়েছেন, তাই তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। তারা আর পদে থাকতে পারবেন না। দ্বিতীয়ত, সবল ব্যাংক তো দুর্বল ব্যাংকের দায় ও সম্পদ সবই নিচ্ছে। অডিটের মাধ্যমে তো চলে আসবে ওই ব্যাংকের সম্পদ কোথায় কী অবস্থায় আছে। যেগুলো নিয়মিত আছে, সেগুলো তো আছেই। আর যেগুলো খেলাপি হয়ে গেছে,  সেটা আদায়ের জন্য তো তারা কোর্টেও যেতে পারবে। মামলা করলেই সব বেরিয়ে আসবে। ঋণটা যথাযথ নিয়ম মেনে দেয়া হয়েছিল কি না, এখানে কোনো অনিয়ম ছিল কি না এবং এর সঙ্গে কারা কারা জড়িত সবই বেরিয়ে আসবে। 

২০২২ সালের জুলাইয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর হিসেবে যোগ দেয়ার পরই ১০টি ব্যাংককে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করে পৃথক তদারকি শুরু করেন। কিন্তু এতে কোনো সুফল আসেনি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ শীর্ষক একটি নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকগুলোকে চার ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। নীতিমালা অনুযায়ী এসব ব্যাংকের নতুন শাখা খোলা, আমানত ও ঋণ বিতরণ বন্ধ এবং একীভূত করার সিদ্ধান্ত দিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের মার্চ থেকে পিসিএ নীতিমালা কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার পরামর্শ দেয়া হয়। এ জন্য ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের এমডিদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করারও পরামর্শ দেন গভর্নর। একই ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয় ৪ মার্চ ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও। ওই বৈঠকে গভর্নর জানান, চলতি বছরের মধ্যে সাতু থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে। এছাড়া ব্যাংক খাতের নানা সমস্যা সমাধানে ফেব্রুয়ারিতে একটি পথনকশাও অনুমোদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানেও ব্যাংক একীভূত করার বিষয়টি ছিল। এরপরই ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এক্সিমের সঙ্গে পদ্মা : প্রথমেই শুরু হয় এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ঝুকিতে থাকা পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করার প্রক্রিয়া। গত ২৫ মার্চ একীভূত হওয়ার বিষয়ে ব্যাংক দুটির মধ্যে সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। পদ্মা ব্যাংক হলো ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ৯ ব্যাংকের একটি। কিন্তু উদ্যোক্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ২০১৭ সালে এটির পর্ষদে পরিবর্তন ঘটে। ২০১৯ সালে দি ফারমার্স ব্যাংকের পরিবর্তে এটির নামকরণ করা হয় ‘পদ্মা ব্যাংক’। সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূলধন এবং আমানতে চলা এই ব্যাংকের দেয়া মোট ঋণের ৬০ শতাংশই এখন খেলাপি। ুবড় আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি।

সিটির সঙ্গে বেসিক : ১৯৮৮ সালে নিবন্ধন নেয়া বেসিক ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে ১৯৮৯ সালে। এক যুগ আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশ ভালো অবস্থানেই ছিল ব্যাংকটি। শিল্প গ্রুপগুলো এই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করত। তখন ব্যাংকটি ভালো মুনাফাও অর্জন করত; উচ্চ বেতনে কর্মী নিয়োগ দিত। সে সময় পদাধিকারবলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব।

২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে চেয়ারম্যান বানিয়ে বেসিক ব্যাংকের নতুন পর্ষদ গঠন করে সরকার। এরপরই ব্যাংকটির ছন্দপতন শুরু হয়। নিয়ম ভেঙে এবং তথ্য গোপন করে একের পর ঋণ দেয় বেসিক ব্যাংক। যার অধিকাংশই আদায় করা যায়নি। সংকট দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে নানা সহযোগিতা করা হয়; কিন্তু আর্থিক সূচকে উন্নতি করতে পারেনি শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর হাতে ডুবে যাওয়া ব্যাংকটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে আবদুল হাই বাচ্চুর নানা অনিয়মের তথ্য। পাঁচ বছর (২০০৯-১৪) দায়িত্বে ছিলেন বাচ্চু। এ সময় ব্যাংকটিতে ঘটে যায় নজিরবিহীন ঘটনা। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ কেলেঙ্কারির বোঝা এখনো বইছে ব্যাংকটি। ২০১৩-২০২২ সাল, অর্থাৎ ১০ বছরে লোকসান দিয়েছে চার হাজার ২৩০ কোটি টাকা। কিন্তু বেসিকের অর্থ আত্মসাৎকারীদের এখনো দৃশ্যমান কোনো শাস্তি হয়নি।

ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে বিকল্প হিসেবে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে আট হাজার ২০৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর প্রভিশন ঘাটতি পাঁচ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতি তিন হাজার ১৫০ কোটি টাকা।

কৃষির সঙ্গে রাকাব : ১৯৭৩ সালে কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। আর ১৯৮৬ সালে উত্তরাঞ্চলের কৃষি ব্যাংকের শাখাগুলো নিয়ে গঠন করা হয় রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এখন আবার দুটি ব্যাংককে এক করে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের বিতরণ করা ৩১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে তিন হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খেলাপির হার ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৩ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া গত ডিসেম্বর শেষে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দুই হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।

সোনালীর সঙ্গে বিডিবিএল : অন্যদিকে ২০১০ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস) একীভূত হয়ে ‘বিডিবিএল ব্যাংক’ নামে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখতে এখন রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৪২ শতাংশই ছিল খেলাপি। এ সময় পর্যন্ত বিডিবিএলের ঋণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৩১৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ৯৮২ কোটি টাকা। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ৯৩ হাজার ৯৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। 

ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল : নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও জালিয়াতির কারণে ডুবছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। এক পর্যায়ে গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখতে এখন বেসরকারি খাতের ইউসিবি ব্যাংকের সঙ্গে  একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী  গত ডিসেম্বর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১১ হাজার ৭২০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২৯ শতাংশ। আর গত বছর শেষে ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং ঘাটতি ছিল প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ইউসিবির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের পাঁচ শতাংশ।