ডলারের দাম এক লাফে বেড়েছে সাত টাকা

আমদানিকারকদের জন্য দুঃসংবাদ

জাহাঙ্গীর আলম আনসারী প্রকাশিত: মে ৯, ২০২৪, ০১:১৯ পিএম
আমদানিকারকদের জন্য দুঃসংবাদ

মূল্যস্ফীতি বাড়বে 
—সভাপতি, দোকান মালিক সমিতি

দেশের জন্য ভালো খবর নয় 
—নির্বাহী সভাপতি, বিকেএমইএ  

ডলারের দর নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে বাংলাদেশে এক লাফে সাত টাকা বেড়েছে মার্কিন ডলারের দাম। বাজারে চা?হিদার তুলনায় সরবরাহ কম এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের কারণে ডলারের অফিসিয়াল দাম ১১০ থেকে ১১৭ টাকায় উন্নীত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

গতকাল বুধবার এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এখন থেকে ক্রলিং পেগ নামের নতুন পদ্ধতিতে ডলার কেনাবেচা হবে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দাম ছিল ১১০ টাকা, যা ছিল অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাফেদা নির্ধারিত ডলার রেট। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর ফলে আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় আমদানি খরচ বেড়ে যাবে, দাম বাড়বে পণ্যের। চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে এবং নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমদানিতে। 

‘ক্রলিং পেগ’ হচ্ছে দেশি মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না। এখন থেকে মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। এর সঙ্গে এক টাকা যোগ ও এক টাকা বিয়োগ করতে পারবে ব্যাংকগুলো। এর মানে ডলারের সর্বোচ্চ দর হবে ১১৮ টাকা। এতদিন ডলার বিক্রির আনুষ্ঠানিক দর ছিল ১১০ টাকা। আর ব্যাংকগুলো কিনত ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায়।

২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এছাড়া আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। এখন হঠাৎ করে ডলারের দাম এক লাফে সাত টাকা বাড়ায় পণ্য আমদানিতে বড় প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে আরও বাড়বে মূল্যস্ফীতি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, এখন যে অবস্থা চলছে, এটা কোথায় গিয়ে যে শেষ হবে জানি না। আমাদের দেশ হলো আমদানিনির্ভর দেশ। এখানে যদি ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে মানুষের কষ্ট হবে এবং দেশে এক ধরনের সংকটের সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিকল্পনা থাকা দরকার। কত দিনের মধ্যে তারা ডলারের দামকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে আসবে— সেটা জানানো দরকার। তারা বারবার ডলারের দাম বাড়াবে আর বারবার মানুষের কষ্ট হবে— সেটা তো হয় না। অজানার পথে যাত্রা, সেটা হতে পারে না।

এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, সাত টাকা কিন্তু অনেক টাকা। এর ফলে আমদানিতে সাংঘাতিক প্রভাব পড়বে। পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাবে অনেক, পণ্যের দামও বাড়াতে বাধ্য হবে আমদানিকারকরা।
ডলারের বাড়তি দাম নিয়ে কথা বললে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ডলারের দাম ১১০ থেকে ১১৭ টাকা হয়েছে— এটা আমাদের জন্য ভালো সংবাদ। কিন্তু দেশের জন্য ভালো সংবাদ নয়। ডলারের দাম বাড়ার ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং জনগণের ওপর চাপ বাড়বে। তারপর ডলারের দাম বাড়িয়ে লাভ কী? কারণ ডলার কিনতে গিয়ে যদি আমাকে আবার ১০-১৫ টাকা বেশি দিতে হয়, তাহলে ডলারের দাম বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। কোনো অবস্থাতেই ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে এক টাকার বেশি পার্থক্য করা যাবে না।

তিনি বলেন, ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানি ব্যয় বাড়বে। এখন আমি কিছু কিনতে গেলে বেশি দাম দিতে হবে; যার ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।

বেড়েছে নীতি সুদহার 

এদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার (পলিসি রেট) ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে আট দশমিক পাঁচ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আজ থেকে নতুন সুদহার কার্যকর হবে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক নীতি অনুসরণ করছে।

এছাড়া স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাত শতাংশ করা হয়েছে।
তবে খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীতি সুদহার বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। এর আগেও মূল্যস্ফীতি কমাতে কয়েকবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। গত মার্চ মাসেও মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। 

সূত্রমতে, ২০২৩ সালের জুন মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। পরে মাস জুলাইয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দফা মুদ্রনীতি ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রনীতিতে নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ছয় দশমিক ৫০ শতাংশ করে। আর মূল্যস্ফীতি হ্রাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বহুল ব্যবহূত নীতিগত উপায় হলো সুদহার বাড়ানো। রেপো রেট হিসেবেও পরিচিত নীতি সুদহারের বৃদ্ধি  কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অর্থ ধারের খরচ বাড়ায়, এতে ঋণের সুদহারও বাড়ে। ঋণের সুদহার বাড়লে ভোক্তাদের জন্য ঋণ নেয়ার খরচ বাড়ে, এতে ঋণ চাহিদা কমে এবং শেষ পর্যন্ত তা মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে ভূমিকা রাখে।

এরপর ২০২৩ সালের জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে। পরের মাস আগস্টে এই মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ওই সময় দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে চাপে পড়ে যায় সরকার। চতুর্মুখী সমালোচনার মুখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আবার নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নীতি সুদহার একবারেই শূন্য দশমিক ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাত দশমিক ২৫ শতাংশ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরপর গত বছরের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি আগস্টের চেয়ে সামান্য কমে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশে আসে। কিন্তু পরের মাস অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে।

তারপর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত বছরের ২২ নভেম্বর আবার নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার (পলিসি রেট) ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাত দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়। তারপর চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে আট শতাংশ করা হয়। সর্বশেষ ৮ মে নীতি সুদহার আরেক দফা বাড়িয়ে আট শতাংশ থেকে আট দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।