জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জুলাই মাসজুড়ে সারাদেশে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে কী অর্জন করল সেই আলোচনা রয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
কারণ, গোপালগঞ্জে দলটির কর্মসূচি ঘিরে সহিংতা ও হতাহতের ঘটনা ইতিবাচক কোনো ফল দেয়নি।
কক্সবাজারসহ কয়েকটি জায়গায় এনসিপি নেতাদের অনেকের বক্তব্য বিতর্ক তৈরি করলে বাধার মুখে পড়েছিল তাদের কর্মসূচি। রাষ্ট্রীয় সুবিধা এবং বিভিন্ন বাহিনীর নিরাপত্তা নিয়ে কর্মসূচি পালনের অভিযোগও ওঠে দলটির বিরুদ্ধে।
যদিও এনসিপির নেতারা বলেছেন, সারাদেশে তারা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছেন।
বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারিতে আত্মপ্রকাশের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তৃণমূলে দলকে বিস্তৃত করতে মাসব্যাপী পদযাত্রা করেছিল এনসিপি। কিন্তু ছাত্র ও শহরকেন্দ্রিক দলটি আসলে কতটা সাড়া পেল, সেই প্রশ্নে সন্দেহ রয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের।
এনসিপির কর্মসূচি নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা, নানা আলোচনার মধ্যেই নরসিংদী ও সাভারে তাদের মাসব্যাপী পদযাত্রা কর্মসূচি শেষ হয়। সেদিন নরসিংদীতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থান।
নরসিংদী পৌরসভা মোড়ে ত্রিমুখী রাস্তার সংযোগ সড়কে বেশ বড় একটি মঞ্চ বানানো হয়েছে। মঞ্চের সামনে এনসিপির নেতাকর্মীদের ভিড়। তারা অপেক্ষা করছিলেন এনসিপির শীর্ষ নেতাদের জন্য। শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো ঘুরে বিকেলে এনসিপি নেতাদের পদযাত্রা যখন পৌঁছে যায় পৌরসভা মোড়ে, স্লোগানে মুখর ভিড় ঠেলে ঠেলে মঞ্চে উঠতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো নেতাদের।
একইদিন সাভারে পথসভার মাধ্যমে শেষ হয় পদযাত্রা।
‘প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সাড়া পেয়েছি’
এনসিপির পদযাত্রায় দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা শুরু থেকেই অংশ নিয়েছেন। পাঁচ মাস আগে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে একটি সমাবেশের মাধ্যমে দলটি যখন আত্মপ্রকাশ করে, তখন অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত এই দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে রাজনীতিতে নতুন এসে তারা দেশব্যাপী সাংগঠনিক বিস্তৃতি এবং নতুন সমর্থকগোষ্ঠী কতটা তৈরি করতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল।
জুলাই মাসব্যাপী দেশজুড়ে পদযাত্রাকে এখন সেই প্রশ্নেরই উত্তর হিসেবে ব্যাখ্যা করছে এনসিপি।
দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা বলেন, এই পদযাত্রায় তারা প্রত্যাশার চেয়েও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বেশি সাড়া পেয়েছেন। আমরা মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি সাড়া ও ভালোবাসা পেয়েছি। আমরা মানুষের কাছাকছি গিয়ে তাদের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করেছি। আমরা তাদের কাছে যে কথাগুলো শুনেছি, যেসব সমস্যা পেয়েছি সেগুলোকে ঘিরেই আমাদের রাজনীতি হবে। সেই অভিজ্ঞতাকে কাছে লাগিয়েই রাজনীতিকে এগিয়ে নেবো আমরা।
কিন্তু এতে করে দলটির তৃণমূলে কি সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে? এমন প্রশ্নে এনসিপির শীর্ষ নেতা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, এনসিপি গণমানুষের দল হয়ে উঠছে। আমাদের পথসভাগুলো জনসভায় রূপান্তরিত হয়েছে। অনেক জায়গায় জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। যেখানে আমাদের সাংগঠনিক লোক নেই, সেখানেও সাধারণ মানুষ কিংবা উৎসুক জনতা, তারাই আমাদের কর্মসূচিতে এসেছে, সমর্থন দিয়েছে।
ঢাকা থেকে তৃণমূলে পৌঁছানো কতটা হলো?
জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃত্বে যারা আছেন, তারা যেমন তরুণ, তেমনই ঢাকা-কেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে দলটির যে সাংগঠনিক তৎপরতা সেটাও মূলত শহরকেন্দ্রিক। দলটি এর মধ্যে যেসব বড় কর্মসূচি পালন করেছে সেগুলোও সীমাবদ্ধ ছিল ঢাকার ভেতরে। ফলে তৃণমূলে দলের সাংগঠনিক বিস্তৃতি কীভাবে হবে কিংবা দলটি কতটা গণমানুষের দল হয়ে উঠবে সেটা ছিল বড় প্রশ্ন।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, পদযাত্রা কর্মসূচির অংশ হিসেবে গ্রামে-গঞ্জে এবং বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার পর তাদের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে ‘বাড়তি আত্মবিশ্বাস’ তৈরি হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের সময় আমরা ছিলাম ছাত্রনেতা। আমাদের আন্দোলন কিংবা রাজনীতি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক। সেখান থেকে এখন আমরা গণমানুষের যে নেতৃত্ব, সে জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছি। মানুষের কাছাকাছি আমরা যেতে পেরেছি।
নাহিদ ইসলামের মত হচ্ছে, ঢাকা-কেন্দ্রিক হওয়ায় তৃণমূল মানুষের সঙ্গে দলের একটা ‘বিচ্ছিন্নতা’ তৈরি হয়েছিলো, যেটা এখন কেটে যাচ্ছে।
নাহিদ বলেন, এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সারাদেশের মানুষকে আমরা কানেক্ট করেছি। গণ-অভ্যুত্থানের সময় আমাদের যে স্লোগান ছিল–– ‘তুমি কে আমি কে; বিকল্প, বিকল্প’ সেই বিকল্প নেতৃত্ব মানুষ দেখতে পাচ্ছে।
কিন্তু সাধারণ মানুষ কী মনে করছে?
গত মঙ্গলবার গাজীপুরে দলটির সমাবেশের আগে-পরে কথা হয় বিবিসি বাংলার সঙ্গে স্থানীয় কিছু মানুষের সঙ্গে। সেখানে স্থানীয় পোল্ট্রি ব্যবসায়ী আহমদ আলী বলেন, এনসিপির নাম তিনি সম্প্রতি শুনেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে তো আওয়ামী লীগ আর বিএনপি -এরাই বড় দল। এনসিপি এখানে ছোট দল। এখনেও তো আমাদের এলাকার অনেক মানুষ এই দলটার নাম জানে না, বোঝেও না। আজকেও তো অনেকে জিজ্ঞাসা করলো এটা কোন দল।
তার মতে, হঠাৎ করে কোন দল বড় হতে পারে না, তবে চেষ্টা করলে এনসিপির বড় দল হওয়ার সুযোগ আছে বলে মন্তব্য করেন ব্যবসায়ী আহমদ আলী।
একইদিনে কথা হয় গাজীপুর শহরে এনসিপির সমাবেশে আসা নুরুল ইসলাম বলেন, আমি এনসিপিও করি না, অন্য দলও করি না। আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখতে আসছি। তারা দেশে অভ্যুত্থান করেছে, এজন্য বাস্তবে তাদের একটু দেখতে আসছিলাম।
দেখে কী মনে হলো এমন প্রশ্নে তার উত্তর, ভালোই। যারা আসছে তাদের বেশিরভাগই ছাত্র-তরুণ। তাদের কথা-বার্তা তো ভালোই লাগলো।
‘সরকারি সুবিধা’ নিয়ে কর্মসূচি?
এনসিপির দুটি সমাবেশস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, নাহিদ ইসলাম, নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারি, তাসনিম জারা, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ কিংবা সামান্থা শারমিনদের মতো এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের ঘিরে দলের কর্মীসহ সাধারণ মানুষের আগ্রহ রয়েছে। ফলে দলটির পদযাত্রা কিংবা সমাবেশগুলোতে জমায়েতও হয়েছে। আবার একইসঙ্গে কর্মসূচিকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যপক তৎপরতাও চোখে পড়েছে। সমাবেশস্থল তো বটেই মিছিলের সামনে-পেছনে এবং গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতেও নিরাপত্তা সুবিধা দিতে দেখা যায় পুলিশকে। সব মিলিয়ে ‘সরকারি সুবিধা নিয়ে কর্মসূচি পালন করছে এনসিপি’–– এমন আলোচনাও আছে।
জানতে চাইলে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অবশ্য বলছেন, তারা সরকারের কাছে কোনো বাড়তি সুবিধা চাননি।
তিনি বলেন, আমরা সরকারি দলের সুবিধা পেলে গোপালগঞ্জে আমাদের জীবন হুমকিতে পড়তো না। সেখানে যে হামলা হলো, সেটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয় হয়ে গিয়েছিলো। আমরা সবখানে বলেছি, আমাদের অতিরিক্ত কোনো প্রশাসনিক নিরাপত্তা দরকার নেই। কিন্তু সরকারের এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভাবমূর্তির একটা বিষয় আছে। সে কারণে তারা তাদের জায়গা থেকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। এটা আমরা চেয়েছি এমন না। আমরা জীবন হাতে নিয়েই অভ্যুত্থানে করেছিলাম, এখন জীবন হাতে নিয়েই রাজনীতিতে নেমেছি।
গোপালগঞ্জে ‘ছন্দপতন’?
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে হামলা কিংবা কক্সবাজারে দলটির সমাবেশস্থল ভাঙচুরের পর দলের কার্যক্রমে এর প্রভাব দেখা গেছে।
দলটির নেতারা প্রকাশ্যে সেটা স্বীকার না করলেও পরবর্তীকালে দলটির পদযাত্রায় এক ধরনের নিরাপত্তার ঘেরাটোপ দেখা যায়। তাদের কর্মসূচির ধরনেও কিছু পরিবর্তন আসে।
জুলাই মাসের শুরুতে পদযাত্রার শুরুর দিনগুলোতে মাইলের পর মাইল হেঁটে মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা থাকলেও শেষ দিকে, বিশেষত গোপালগঞ্জের ঘটনার পর কিছুটা ক্লান্তি, কিছুটা বৈরি আবহাওয়া আর কিছুটা নিরাপত্তা সতর্কতা -সব মিলিয়ে কোথাও কোথাও এনসিপির পদযাত্রা সীমাবদ্ধ হয়ে যায় মূলত পথসভায়। এ সময় পদযাত্রা হলেও দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে পদযাত্রাগুলো হয়েছে সংক্ষিপ্ত।
এনসিপি এই পদযাত্রা কর্মসূচির মাধ্যমে কতটা গণসম্পৃক্ত হতে পারলো–– এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ মনে করেন, গণসম্পৃক্ততা বা সমর্থন বুঝতে হলে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে দলটিকে। শুরু থেকে যদি তারা কনফ্লিক্টিং (পরস্পরবিরোধী বক্তৃতা-বিবৃতি না দিতো, কাউকে মৌখিকভাবে আক্রমণ না করতো, তাহলে আমার মনে হয় এই দলের একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতো। এখন তাদের জনভিত্তি যে শুধু পদযাত্রার ওপর নির্ভর করবে তা নয়। তারা কী করতে চায়, সেটা কিন্তু মানুষের কাছে এখনেও সেভাবে পৌঁছায়নি।
অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ আরও বলেন, দল হিসেবে প্রাথমিক যে পরিচিতি দরকার। এনসিপি সেটা করতে পেরেছে। তারা মানুষের কাছে গিয়েছে। দলের পরিচিতিটা হয়ে গেছে। আপাতত এটাই তাদের একটা অর্জন।
সূত্র: বিবিসি
ইএইচ