নির্বাচনের আগের সময়টা কঠিন, পুলিশকে সজাগ থাকতে হবে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমরা একটি ন্যায্যতার ভিত্তিতে গঠিত বৈষম্যমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখছি। আমরা দ্বিতীয় বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। এ সুযোগ যেন আমরা না হারাই। এ সুযোগ হারালে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে চিরজীবনের জন্য দায়ী থাকব।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ‘পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫’-এর উদ্বোধন এবং পুলিশ সদস্যদের পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
নতুন বাংলাদেশের পথে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে ড. ইউনূস বলেন, বিশ্বের বুকে একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এবং আগামীতেও তা ধরে রাখবে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। আপনাদের কাজ, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক- সবকিছু দেখেই দুনিয়া বিচার করে, আমরা সভ্যতার কোন স্তরে আছি। আমরা চাই, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রশংসিত হোক।
পুলিশ বাহিনীর ঐতিহাসিক ভূমিকার স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাঙালি পুলিশ সদস্যরাই সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এটাই বাংলাদেশ পুলিশের গৌরবময় ইতিহাসের সূচনা। আমরা শহীদ পুলিশ সদস্যদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই এবং আশা করি, তাদের আদর্শ অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বৈষম্যহীন, ন্যায়ের সমাজ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাবে।
আওয়ামী লীগ আমলের সমালোচনা ও সংস্কারের অঙ্গীকার : তবে বিগত ১৫ বছরের ‘স্বৈরাচারী শাসনামলে পুলিশ বাহিনী দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল’ উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এতে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় এবং বহু সৎ পুলিশ সদস্যকেও এর খেসারত দিতে হয়েছে। আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার সময় পুলিশ বাহিনী ছিল ভঙ্গুর অবস্থায়। তখন থেকে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
তিনি জানান, জনগণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা নিরসন, বিশেষ অভিযান, অংশীজনদের সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ, মনোবল বৃদ্ধির জন্য প্রণোদনা ও উৎসবগুলো শান্তিপূর্ণভাবে পালন নিশ্চিত করতে সমন্বিত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
নারী ও শিশু নিরাপত্তায় জোর প্রধান উপদেষ্টার : ড. ইউনূস বলেন, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশকে সর্বোচ্চ সংবেদনশীল হয়ে কাজ করতে হবে। নারী ও শিশুরা যেন প্রয়োজনে পুলিশের হটলাইনে ফোন করে সহজে সাহায্য পেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই বোঝা যাবে, দেশ নিরাপত্তা ও মানবিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে।
নির্বাচন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সতর্কবার্তা : প্রধান উপদেষ্টা বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন যেন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়, তা নিশ্চিত করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব। পুলিশ সদস্যদের এ সময় অত্যন্ত সতর্ক ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। সব প্রার্থী যেন সমান সুযোগ পায় এবং ভোটাররা যেন ভয়মুক্ত পরিবেশে ভোট দিতে পারে এটাই মূল লক্ষ্য।
ভবিষ্যতের নিরাপদ পুলিশ বাহিনী গড়ার বার্তা : ড. ইউনূস বলেন, নির্বাচনে কোনো অন্যায় বা অনিয়মের মাধ্যমে কেউ নির্বাচিত হলে ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই পুলিশ সদস্যদের সত্য ও ন্যায়ের পক্ষেই থাকতে হবে- একজন নাগরিক ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ভূমিকা থেকে। তিনি আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতে যেন আর কখনও পুলিশ বাহিনীকে কোনো দল বা অন্যায় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা না যায়, তার জন্য একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। নির্বাচনের আগে ও পরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপচেষ্টা হতে পারে- আপনাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে দেশবিরোধী বা পরাজিত শক্তি সে সুযোগ না পায়।
জাতীয় ঐক্যের আহ্বান : ড. ইউনূস বলেন, আমরা এখন এক ধরনের যুদ্ধাবস্থায় রয়েছি। অশুভ চক্র আমাদের স্বপ্ন ও ঐক্য নষ্ট করতে চেষ্টা করছে। আপনাদের সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে- জনগণ ও জাতির নিরাপত্তা রক্ষায় কোনো ঘাটতি রাখা যাবে না।
তিনি প্রশংসা করে বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিভিন্ন ন্যায্য ও অন্যায্য ইস্যুতে মানুষ রাস্তায় নেমেছে, কিন্তু পুলিশ বাহিনী ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। আমি আশা করি, ভবিষ্যতেও আপনারা একইভাবে শান্তিপূর্ণ ও পেশাদার আচরণ বজায় রাখবেন। জনগণের বন্ধু হিসেবে পুলিশের যে ভাবমূর্তি, তা আপনাদেরই প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সম্প্রীতির উদ্যোগ, ধর্মীয় নেতা ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে সংলাপ : তিনি বলেন, প্রথমবারের মতো পুলিশ সপ্তাহে ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক ও বিভিন্ন সমপ্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে- এটি একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। জনগণের প্রত্যাশা ও পুলিশের দায়িত্ব নিয়ে নিয়মিত সংলাপ হলে দূরত্ব কমবে, বোঝাপড়া বাড়বে। আমি চাই, এটি যেন প্রতিবছর নিয়মিত হয়, শুধু পুলিশ সপ্তাহে নয়, সুযোগ পেলেই এ ধরনের বৈঠক হওয়া দরকার।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. বাহারুল আলম এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি।