পাল্টাপাল্টি হামলায় বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ

• ইসরাইলকে সহায়তার ব্যাপারে তিন দেশকে সতর্ক করল ইরান
• ইসরাইলি হামলায় ইরানের ৯ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত
• ইরানের প্রতি পাকিস্তানের পূর্ণ সমর্থন

গত শুক্রবার থেকে নতুন মাত্রা লাভ করেছে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যকার সংঘাত। ইসরাইলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ (Operation Rising Lion) নামে পরিচিত আকাশপথে পরিচালিত এই হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রসহ শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এই হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাসহ অন্তত ৭৮ জন নিহত ও ৩২০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। 

ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাতজ সতর্ক করে বলেছেন, ‘তেহরান পুড়ে যাবে’ যদি ইরান তার আগ্রাসন অব্যাহত রাখে। এদিকে ইরানের পাল্টা হামলায় শুক্রবার সন্ধ্যায় ১৫০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ১০০টিরও বেশি ড্রোন ইসরাইলের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানে। এই হামলায় তেল আবিবের রিশন লেজিয়ন শহরে তিনজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। ইরান দাবি করেছে যে, তাদের হামলায় তিনটি F-35 যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে এবং জর্ডানে তিনজন বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছেন। 

ইসরাইলের এই হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক সমৃদ্ধি কেন্দ্রসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানে একটি গোপন ড্রোন ঘাঁটি স্থাপন করে এই হামলা পরিচালনা করেছে, যা ইরান-ইসরাইল সংঘাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ইরান এই হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ III’ (Operation True Promise III) নামে পরিচিত পাল্টা হামলা চালিয়েছে। ইরান সতর্ক করে দিয়েছে যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স তাদের আঞ্চলিক স্থাপনা রক্ষায় হস্তক্ষেপ করে, তবে তাদেরও লক্ষ্যবস্তু করা হবে। এই সংঘাতের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব নেতারা উভয়পক্ষকে শান্তির পথে ফিরে আসার আহ্বান জানালেও পরিস্থিতি এখনও অস্থিতিশীল। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের মহাসচিব উভয়পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। এই সংঘাতের পরিণতি কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, সারা বিশ্বের নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্ববাসী এখন গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অপেক্ষা করছে। 

ইসরাইলকে সহায়তার ব্যাপারে তিন দেশকে সতর্ক করল ইরান : ইসরাইলকে সহায়তার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে সতর্ক করেছে ইরান। বলা হয়েছে, ইসরাইলকে লক্ষ্য করে চালানো ইরানি হামলা প্রতিহত করতে সাহায্য করলে তাদের এই অঞ্চলে থাকা ঘাঁটি ও জাহাজ লক্ষ্যবস্তু করা হবে।

ইরান সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যদি কোনো দেশ ইরানের হামলা প্রতিহত করতে ইসরাইলকে সহায়তা করে, তবে সেই দেশের পারস্য উপসাগরীয় ঘাঁটিসহ আঞ্চলিক সব সামরিক স্থাপনা, জাহাজ ও নৌবাহিনীর ওপর আঘাত হানা হবে। এই হুঁশিয়ারি এমন এক সময়ে দেয়া হলো যখন মার্কিন কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের দিকে ছোড়া ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে সহায়তা করেছে। 

ইসরাইলের নজিরবিহীন হামলার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে তেহরান ব্যাপক প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়। যদিও যুক্তরাজ্যের কোনো সক্রিয় সামরিক সহায়তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার তেহরানে তাদের দূতাবাস কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সম্ভাব্য প্রতিশোধের আশঙ্কায় নজরদারি জোরদার করেছে। 

এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা তেহরানে তাদের দূতাবাস সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে। ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরাইলে এখন পর্যন্ত অন্তত তিনজন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। এই হামলা ছিল ইসরাইলের চলমান সামরিক অভিযানের জবাবে। ইরান জানিয়েছে, ইসরাইল তাদের বিভিন্ন শহর, সামরিক ঘাঁটি ও পরমাণু স্থাপনায় একের পর এক হামলা চালিয়ে অন্তত ৭৮ জনকে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছে। আহত হয়েছে আরও ৩২০ জনের বেশি।

ইসরাইলি হামলায় ইরানের ৯ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত : ইসরাইলি সামরিক বাহিনী গতকাল শনিবার জানিয়েছে, আগের দিন শুক্রবার ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে তাদের বিমান হামলায় ৯ জন শীর্ষস্থানীয় ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। খবর এএফপির। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে নিহতদের নাম উল্লেখ করে বলেছে, ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন-এর শুরুতে ইসরাইলি বিমান বাহিনীর হামলায় ইরান সরকারের পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ৯ জন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞ নিহত হয়েছেন।’ 

সামরিক বাহিনী বলেছে, ‘তাদের নির্মূল করা ইরানি শাসকগোষ্ঠীর গণবিধ্বংসী অস্ত্র অর্জনের ক্ষমতার ওপর একটি চরম আঘাত।’ সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ‘গোয়েন্দা অধিদপ্তর কর্তৃক সংগৃহীত সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের’ ভিত্তিতে এই হামলা চালানো হয়েছে।

ইরানের প্রতি পাকিস্তানের পূর্ণ সমর্থন : বিশ্বের সব মুসলিম দেশকে অবিলম্বে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়ে ইসরাইলের সঙ্গে চলমান হামলা-পাল্টা হামলার মাঝে ইরানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে পাকিস্তান। গতকাল শনিবার একইসঙ্গে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানায় দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। 

পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা ইরানের পাশে আছি এবং তাদের স্বার্থ রক্ষায় প্রত্যেকটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমর্থন জানাব।  তিনি আরও বলেন, ইরান, ইয়েমেন এবং ফিলিস্তিনকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে ইসরাইল। যদি মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এখন ঐক্যবদ্ধ না হয়, তাহলে প্রত্যেককেই একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। পাশাপাশি ইসরাইল ইস্যুতে একটি যৌথ কৌশল নির্ধারণে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাকে (ওআইসি) জরুরি বৈঠকে বসার প্রস্তাব দিয়েছেন পাকিস্তানের এই মন্ত্রী। খাজা আসিফ বলেন, ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং ইসলামাবাদ ‘এই কঠিন সময়ে তেহরানের পাশে রয়েছে।’