বহুধারায় বিভক্ত বাংলাদেশের মানুষকে কোনো জাতীয় ইস্যুতে এক টেবিলে বসানো খুবই দুরূহ কাজ। নব্বইয়ের দশকে ইমদাদুল হক মিলনের একটা নাটক প্রচারিত হত বিটিভিতে ‘বারো রকম মানুুষ’!
এখন এরকম একটা নাটক লিখলে তিনি কত রকম মানুষ নামকরণ করতেন, তিনিই বলতে পারবেন। সে সময়ের চাইতে দিনে দিনে প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে ঠিক, কিন্তু মানুষের বিভাজন ও অসততার পরিমাণ অনেকগুণ বেড়েছে।
দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের অপশাসনের পর দেশকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সংস্কার কমিশন করে দিয়েছে। সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন। কমিশনগুলো দেশের স্টেকহোল্ডার বিশেষ করে রাজনৈতিক দল এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আলোচনা করে; তাদের মতামত নেয় এবং নিজেদের মতামতকে সম্মিলিত করে রিপোর্ট তৈরি করে তা প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করে। তারপর এই কমিশনগুলোর প্রধানদেরকে নিয়ে গঠিত হয় ঐকমত্য কমিশন, যেখানে অধ্যাপক আলী রীয়াজ সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ঐকমত্য কমিশন কী কী কাজ করল
১. বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিভিন্ন দলের একসঙ্গে বসে আলোচনা করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঐকমত্য কমিশনের প্রথম সফলতা হলো তারা ফ্যাসিস্টবিরোধী সব রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে বসাতে পেরেছে আলোচনা করার জন্য।
২. ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগে ছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন বাদে অন্য কমিশনগুলোর আশু বাস্তবায়নযোগ্য ১৬৫টি সুপারিশ। যা বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে।
আরেক ভাগে ছিল ১৬৬টি মৌলিক সংস্কার সুপারিশ। এই সুপারিশগুলো নিয়ে প্রথম পর্বে (২০ মার্চ-১৯ মে) ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা হয়। প্রথম পর্বে ঐকমত্য না হওয়া ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে (৩ জুন- ৩১ জুলাই) ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন।
৩. প্রথম পর্বের আলোচনায় ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়। দ্বিতীয় পর্বে ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ১১টিতে সব দলের ঐকমত্য এবং ৯টিতে ভিন্নমতসহ (নোট অব ডিসেন্ট) স্বিদ্ধান্ত হয়।
৪. জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যাত্রা শুরু করে ১৫ ফেব্রুয়ারি। প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস তাদের কার্যক্রম চলে। প্রথম পর্বে মোট ৪৪টি বৈঠক হয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। কোনো কোনো দলের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়। দ্বিতীয় পর্বে ২৩ দিন আলোচনা চলে। ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল্ত সংবিধান সংস্কার বিষয়ক ৭০টি, নির্বাচন সংস্কার বিষয়ক ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬ টি ও দুর্নীতি দমন বিষয়ক ২৭ টি।
ঐকমত্য কমিশন কতটুকু সফল
ঐকমত্য কমিশনের মূল দায়িত্ব ছিল সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি সনদ তৈরি করা, যার নাম হবে ‘জুলাই সনদ’ এবং যার ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশ পরিচালিত হবে। ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং প্রত্যেকটা প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত বা বিশ্লেষণ দিয়েছে।
বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের রাজনৈতিক প্রস্তাবনা ৩১ দফা থাকার পরও ঐকমত্য কমিশনের প্রত্যেকটা প্রস্তাব নিয়ে তাদের মতামত দিয়েছে এবং যেগুলোতে একমত হওয়া যাচ্ছে না- সেগুলোর কারণ কী তা নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে। অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাবনা ছিল না। তারা ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাবিত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর সঙ্গেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একমত হয়েছে, খুব কম ক্ষেত্রেই দ্বিমত পোষণ করেছে।
ঐকমত্য কমিশন দ্বিমত পোষণ করা বিষয়গুলো নিয়ে সভা মূলতবি রেখে এর অগ্রগতির জন্য পরের দিন আবার আলোচনায় বসেছে, নিজেদের পক্ষে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছে, কিছু কিছু মৌলিক বিষয়ে রাজনেতিক দলগুলোকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছে। যেমন বিএনপি বৃহত্তর স্বার্থে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর করা মেনে নিয়েছে।
বাম ডান ও মধ্যপন্থি দলগুলো নিয়ে সভা করে সবার মতকে প্রাধান্য দিয়ে বা সব রাজনৈতিক দলকে সমান গুরুত্ব দিয়ে মোটা দাগে ৮২টি মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে আনতে পেরেছে যার মধ্যে অবশ্য ৯টিতে নোট অব ডিসেন্টসহ।
ঐকমত্য কমিশনের দুর্বলতা কী ছিল
ঐকমত্য কমিশন নিজেরা তাদের প্রস্তাবনা তৈরি করে প্রথমে সেই প্রস্তাবগুলো স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোও সেই প্রস্তাবনার উপর মতামত দিয়েছে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মনে হয়েছে তাদের সব প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমত হবে। এই বিষয়টা নিয়েও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ খুব যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন তুলেছিলেন ঐকমত্য কমিশনের প্রতি- সব বিষয়েই যদি একমত হতে হয় তবে আলোচনার প্রয়োজন কী?
কিছু কিছু প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত চিন্তা করেনি বলে মনে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনকে একটি উৎসব হিসেবে নেয় এবং নির্বাচনি ক্যাম্পেইনে ব্যক্তিকেন্দ্রিক একটি প্রচারণাও থাকে সবসময়। কিন্তু প্রপোরশনাল রিপ্রিজেন্টেশন নিয়ে বড় ধরনের কোনো গবেষণা ছাড়াই এই মুহূর্তে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা সুবিবেচনাপ্রসূত হতো না বলেই মনে করি। প্রপোরশনাল রিপ্রিজেন্টেশন পদ্ধতি বিভিন্নভাবে প্রয়োগ হয়। মুক্ত, বদ্ধ এবং মিশ্র। বাংলাদেশের ইউনিয়ন, উপজেলা কিংবা জেলা শহরের মানুষের কাছেও এটা সম্পূর্ণ নতুন একটা অবোধ্য ব্যাপার হিসেবেই আবির্ভূত হত বর্তমান সময়ে। বহু বছর ধরে ভোটাধিকার বঞ্চিত গণমানুষ তাদের প্রার্থী কে জানত না, শুধু তাই না; সার্বিকভাবে ভোট উৎসব থেকে বঞ্চিত হতো।
নারী আসনের ব্যাপারে যে প্রস্তাবনা এসেছে তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করি। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ৫১ শতাংশ নারী এবং ৪৯ শতাংশ পুরুষ। কিন্তু এখনও সংরক্ষিত নারী আসন ৫০টি রেখে এবং মূল নির্বাচনে ৩০০ আসনের ৫ শতাংশ নারী প্রতিনিধি বাধ্যতামূলক অপ্রতূল বলেই মনে হচ্ছে। যদিও আলোচনায় অংশ নেওয়া অনেক দলই নারী নেতৃত্বকে সামনে আনতে চায় না! কিংবা বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষত্রেও নারী নেতৃত্বকে কতটুকু প্রাধান্য দেয়া হয় তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে!
পরিশেষে—
ঐকমত্য কমিশন তাদের শেষ সভায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সময়সীমা দুই বছর নির্ধারন করেছিল। এবং ৮২টি প্রস্তাব সন্নিবেশিত করে নোট অব ডিসেন্টের অপশনসহ জুলাই সনদ প্রস্তুত করে তা ৫ আগস্টের আগেই স্বাক্ষর করা যাবে এরকম আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল। প্রধান উপদেষ্টা যিনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি তিনিও বলেছিলেন, যে যে সংস্কার প্রস্তাবগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে শুধুমাত্র সেইগুলো নিয়েই জুলাই সনদ তৈরি হবে।
কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের সভা শেষ হওয়ার পর দুই একটি রাজনৈতিক দল অনৈক্যের সুরে কথা বলছেন। কেও বলছেন জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া নির্বাচনে যাবো না, আবার বলছেন পি আর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচনে যাব না। আবার কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রে ছাড় দিলেও জুলাই সনদে ছাড় দেব না।
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঐকমত্য কমিশন আইন বিশেষজ্ঞ ও প্রথিতযশা ব্যক্তিদের সঙ্গে বসছেন জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কীভাবে সহজ এবং দ্রুত করা যায় তার সঠিক ভিত্তি বের করার জন্য। আইনজ্ঞদের প্রস্তাবনা নিয়ে তারা পুনরায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসবেন বলেছেন। বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি বলেছে, তারা যে কোনো সময় জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষরের ব্যাপারে নতুন নতুন শর্ত জুড়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
শুরু করেছিলাম ‘বারো রকম মানুষ’ নাটকের কথা দিয়ে। ওই নাটকে একটা পর্বে দেখানো হয় একজন আরামপ্রিয় মানুষ (অভিনেতা তারিক আনাম খান) চেয়ারে বসে তার রাতের খাবার শেষ করেন যেটা তার সহযোগী খাইয়ে দেয় এবং তারপর তার সহযোগীকে বলেন, ‘আমার চোখের পাপড়িগুলো বন্ধ করে দে, আমি ঘুমাব’!!
সুতরাং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি এখনও এত আরামপ্রিয় হয়ে উঠেনি যে সবাই মনে করবে এখন অন্য একজন চোখের পাপড়ি বন্ধ করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার মতো অবস্থায় চলে এসেছে! বরং নিত্য নৈমিত্তিক নানান সমস্যায় জর্জরিত প্রিয় দেশ! আর পতিত ফ্যাসিস্ট প্রতিনিয়ত এই দেশকে পুনরায় অস্থিতিশীল করার জন্য, অকার্যকর করার জন্য, প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলো এই বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করে সকলে মিলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে এবং আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে হোক বা বিরোধীদলে থেকে হোক, সক্রিয় অবদান রাখবে।
লেখক : কলামিস্ট