Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

ইরানের মাখুনিক গ্রামকে কেন লিলিপুটদের গ্রাম বলা হয়?

আমার সংবাদ ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২১, ০৬:৪৫ এএম


ইরানের মাখুনিক গ্রামকে কেন লিলিপুটদের গ্রাম বলা হয়?

রহস্যময় এই বিশ্বে এমন অনেক রহস্যময় জায়গা এবং মানুষ রয়েছে যাদের গল্প শুনলে আপনি হয়তো ভাববেন কোনো রুপকথা গল্পও শুনছেন। কিন্তু বাস্তবেই রয়েছে রহস্যময় স্থান এবং মানুষ। যেমন ইরানের পূর্ব খোরাসান প্রদেশের প্রাচীন গ্রাম মাখুনিক লিলিপুটদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত।

প্রায় ১ হাজার ৫০০ বছরের পুরনো এই গ্রামটির অবস্থান ইরান-আফগানিস্তান সীমান্ত ঘেঁষে দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশের সারবিশেহ কাউন্টির পল্লী জেলা দোরেহতে। বিশ্বের সাতটি আশ্চর্য্যতম গ্রামের মধ্যে এটি অন্যতম। 

মাখুনিক গ্রামকে কেউ বলে 'বামনদের শহর'। কেউ আবার ডাকে 'ছোট মানুষদের বাড়ি'। কেউবা বলে 'ছোট আকৃতির মানুষের দেশ'। তবে গ্রামটি লিলিপুটদের গ্রাম বলেই বেশি পরিচিত।

তবে এই গ্রামটিকে লিলিপুটদের গ্রাম বলা হয়? 

তার কারণ হলো এখানকার মানুষেরা স্বাভাবিক উচ্চতার মানুষের চেয়ে কমপক্ষে ৫০ সেন্টিমিটার খাটো।  এখানকার বাসিন্দারা আফগানিস্তানের নাগরিক। বেশ কয়েকশ বছর আগে তারা সেখানে এসে বসবাস শুরু করে। অতীতে এখানকার বাসিন্দাদের অধিকাংশই উচ্চতায় এক মিটারের বেশি লম্বা হতো না বললেই চলে। 

বিশেষজ্ঞরা জানান, বামন বাসিন্দাদের মুষ্টিমেয় এখনও সেখানে বসবাস করে। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মাঝে বিয়ের প্রথা ছিল, তাদের খাবার ছিল নিম্ন মানের এবং তারা পারদ মেশানো পানি পান করতো। যেকারণে তারা উচ্চতায় বেটে প্রকৃতির হয়ে থাকে।

সেই সময় মাখুনিকের অন্যান্য বাসিন্দাদের গড় উচ্চতার তুলনায় তারা দেড় মিটার খাটো ছিলেন। তারা উত্তরাধীকার সূত্রে প্রজন্মের পর প্রজন্ম খাটো আকৃতির বলে জানা যায়। 

বলা হয়ে থাকে, প্রায় ৪০০ বছর আগে একজন আফগান নাগরিক সপরিবারে আফগানিস্তান ছেড়ে ইরানে আসে। তারা বসবাসের জন্য জায়গা খুঁজতে খুঁজতে মাখুনিকে এসে আশ্রয় নেন। আর এখানেই বসতি গড়ে তোলেন।

এই গ্রাম শুধু রূপেই আকর্ষণীয় নয়, প্রাচীন স্টাইলের স্থাপত্যের জন্যও এটি বেশ পরিচিত। সেই সঙ্গে এখানকার মানুষের অনন্য ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রয়েছে যা উল্লেখ করার মতো। মাখুনিকের মানুষেরা নব্যপ্রস্তরযুগের স্থাপত্য শৈলীর ভিত্তিতে তারা তাদের বাড়ি নির্মাণ করে। স্থাপনাগুলোর রঙ এমন ছদ্মবেশী-আবরণ তৈরি করেছে যা দূর পাহাড় থেকে শনাক্ত করা অসম্ভব। আপনি গ্রামের সরু গলি দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখতে পাবেন রোদে পোড়া ছোট ছোট ইটের ঘর।

বসতির প্রাচীর ও দরজাগুলো খুবই ক্ষুদ্র আকৃতির। এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘরগুলো পাহাড়ের ঢালে একটার পর একটা নির্মাণ করা হয়েছে। ঘরগুলো দেখতে অনেকটা গুহা সদৃশ। মাখুনিকের বাসিন্দারা উচ্চতায় খাটো হওয়ার কারণে ঘরগুলো ছোট ছোট এমনটা নয়। মূলত বাসাবাড়ি নির্মাণের উপকরণ নিয়ে আসার মতো তেমন কোনো বাহন ছিল না।

অর্থাত্‍ পর্যাপ্ত উপকরণের অভাবে ঘরগুলো ছোট ছোট করে তৈরি করা হয়। সেসময় গৃহপালিত পশু দিয়ে মালবাহী গাড়ি টানা হতো। তবে তাও ছিল দুর্লভ। রাস্তাগুলোও ছিল সংকীর্ণ। এছাড়া আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে বৃহদাকৃতির বাসাবাড়ির চেয়ে ছোটা ছোট ঘর গরম ও ঠাণ্ডা করা সহজ ছিল। এই অঞ্চলে জ্বালানী ছিল অপর্যাপ্ত। ফলে মানুষের বাসাবাড়ি গরম করতে গুরুতর সমস্যায় পড়তে হতো। 
ঘরের ভেতরে যাতে ঠাণ্ডা আবহাওয়া না ঢুকে এজন্য তারা জানালাগুলো অত্যন্ত ছোট করত। 

প্রায় ৫০ বছর আগেও মাখুনিকের মানুষেরা চা পান করতো না। শিকার ও মাংস খাওয়াকে তারা অপরাধ হিসেবে গন্য করতো। এখানে কোনো টিভিও নাই। কারণ গ্রামবাসীদের বিশ্বাস টিভি রাখা শয়তানের কাজ। গ্রামের বাসিন্দাদের অধিকাংশই গবাদিপশু পালন ও কৃষির ওপর নির্ভরশীল। 

তাদের কেউ কেউ গ্রামের কাছে একটি খনিতে কাজ করে। এখানে উত্‍পাদিত কৃষি পণ্যের অধিকাংশই গম, রসুন, শালগম, বিটরুট, গাজর, টমেটো, পেঁয়াজ এবং জাফরান। গ্রামের বাসিন্দারা ফারসিতে স্থানীয় বিশেষ বাচনভঙ্গিতে কথা বলে। এই গ্রামের কেউ ধুমপান করে না। কারণ মাখুনিকের লোকজন ধুমপানকে নিষিদ্ধ মনে করে এবং এটাকে তারা সম্প্রদায়ের জন্য বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করে। 

১৯৪৬ সালে গ্রামটির অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়। এরপরেই সেখানে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করা হয়। গ্রামে প্রবেশের জন্য গাড়িঘোড়া উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। অতীতে অঞ্চলটিতে গাধা, গরু ও ঘোড়ার মতো প্রাণীর অভাবে লোকজন দূরের কোথাও গিয়ে ভবন নির্মাণের উপকরণ নিয়ে আসতে পারতো না। খাওয়ার জন্য বাহিরের কোথাও থেকে খাবার সামগ্রীও নিয়ে আসতে পারতো না। গ্রামটিতে বর্তমানে পানি, বিদ্যুত্‍, একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, একটি প্রাথমিক স্কুল, একটি বাথরুম রয়েছে। সেই সঙ্গে মুদি দোকান, কসাইখানা ও বেকারীসহ কয়েকটি দোকান রয়েছে। 

এখানকার বর্তমান বাসিন্দারা এখন গড় উচ্চতার। বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি অঞ্চলটিতে রাস্তাঘাট নির্মাণ শুরু হয়, গাড়িঘোড়ার সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ফলে মাখুনিকের বাসিন্দাদের বিচ্ছিন্নতা কমে যায়। জীবনমান বিকশিত হতে থাকে। ফলে শিশুরা তখন থেকে লম্বা হতে দেখা যায়। তারা তাদের প্রাচীন বাড়িঘরগুলো পরিত্যাগ করে ইটের বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। গ্রামের তরুণরা কাজকর্মের জন্য কাছের শহরগুলোতে যাওয়া শুরু করে, মেয়েরা গালিচা বোনার কাজ শুরু করে।

২০০৫ সালে এই গ্রামে গবেষকরা ২৫ সেন্টিমিটার উচ্চতার একটি মমি খুঁজে পান। তারপর থেকে তারা বিশ্বাস করেন, মাখুনিকসহ আশেপাশের গ্রামে একসময় বেটে মানুষদের বসবাস ছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই গ্রাম নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। বাড়িগুলোর আকার-আকৃতিই বলে দেয় যে, সেখানকার মানুষ ছোট আকৃতির ছিল। এর প্রমাণও মিলেছে পরে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা সেখানে প্রথম দফায় মোট ৮০০টি কবরের সন্ধান পেয়েছেন। সেই কবরগুলোতে যেসব কঙ্কাল বা দেহের অবিশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে, সেগুলোর সবই একেবারে বামন আকৃতির মানুষের।

গবেষকদের মতে, গ্রামটিতে বসবাসকারী মানুষগুলোর গড়া উচ্চতা ছিল ৩ ফুট। গবেষকরা বলছেন, দুর্গম পাহাড়ের ফাঁকে অবস্থিত এই গ্রামের মানুষ খর্বকায় হওয়ার অন্যতম কারণ অপুষ্টি। কারণ সেইরকম কোনো পুষ্টিকর খাবারই এরা খেতে পেত না। এছাড়া নিকটআত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ে, পারদযুক্ত দুষিত পানি পানের কারণেও এখানকার অধিবাসীদের আকৃতি কম বলে তারা মনে করছেন। এই গ্রামে এখন ৭০০ জন অধিবাসী রয়েছেন। 

আমারসংবাদ/এডি