ঢাকা
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,
আমার সংবাদ ডেস্ক
ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১, ০৭:২০ এএম
"সিরিয়াল কিলার" শব্দটি তো গল্পের বইয়ে কিংবা সিনেমায় অনেকবার দেখেছেন কিংবা শুনেছেন। কিন্তু জানেন কি বাস্তবে আসলেই এমন অনেক সিরিয়াল কিলার আছে, যাদের গল্প শুনলে শিউরে উঠবেন আপনিও। হত্যা করাই যাদরে নেশা। নেশা মেটাতেই খুনের মতো নৃশংস কাজ অবলীলায় করে বেড়ান তাঁরা।তাদের একের পর এক খুনের পেছনে থাকা মোটিভগুলোও হয় অদ্ভুত, ও অবিশ্বাস্য!
তেমনই একজন অদ্ভুত সিরিয়াল কিলার ইতালির লিওনার্দা সিয়ানসিউলি। লিওনার্দা যে শুধু মানুষ খুন করতেন না, তার মানসিকতা এতটাই বিকৃত ছিল যে তিনি মানুষ খুন করে সেসকল মৃতদেহের হাঁড়-চর্বি-গোশত দিয়ে সাবান এবং কেক বানাতেন।
লিওনার্দা বড় হয়েছেন এক ধার্মিক পরিবারে। তার পরিবার শুধু ধার্মিক ছিলনা, তার পরিবার ছিল নানান ধরনের ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কুসংস্কারে ভর্তি। লিওনার্দার বেড়ে ওঠার পরিবেশ স্বাভাবিক ছিলনা বলেই হয়তো তার বিকৃত মানসিকতা এতো বিকৃত ছিল।
লিওনার্দার মা এমিলি ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। সেই সঙ্গে ছিলেন খুবই সুন্দরী। অন্যদিকে, লিওনার্দার বাবা চিয়েন্ড চিলি ছিলেন অত্যন্ত গরিব এবং বয়স্ক এবং নেশায় আসক্ত একজন ব্যক্তি। তবে তিনি এমিলিকে খুবই পছন্দ করতেন। তিনি এটাও জানতেন এমিলিকে পাওয়া তার জন্য অসম্ভব। তখন এমিলির জন্য পাত্র দেখা হচ্ছিল। তাকে শিক্ষা দেয়া হচ্ছিল নানা বিষয়ে। কীভাবে সমাজের অভিজাত মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করা যায়, মানিয়ে চলতে হয়। বাড়িতে চার-পাঁচ জন দাসী ছিল এমিলির।
এদিকে তাকে এক নজর দেখতে ৪০ উর্ধ্ব এক ব্যক্তি প্রতিদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন এক পাত্রের সঙ্গে দেখা করে এমিলি বাড়ি ফিরছিলেন। দাসীদের আগেই বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেসময় সেই লোকটির সঙ্গে তার দেখা হয়। জোর করে একটি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এমিলিকে ধর্ষণ করে চিয়েন্ড চিলি । যৌন সম্পর্ক এবং এসব বিষয়ে ১৬ বছরের এমিলির খুব বেশি ধারণা না থাকায় সেটি বুঝতে পারে নি সে। কয়েকমাস পর এমিলির পরিবার বুঝতে পারে সে গর্ভবতী। তখন চিয়েন্ড চিলির সঙ্গেই তার বিয়ে দিয়ে দেয় তারা।
এরপর বড়লোক বাড়ির মেয়ে বস্তিতে মানিয়ে নিতে পারেনি একেবারেই। সেই সঙ্গে আছে নানান রকম অপবাদ। এমিলি তার সন্তানকেই তার কষ্টের জন্য দায়ী করত সব সময়। শিশুটি জন্মের পর তাকে খুবই নির্যাতন করত। সারাক্ষণ মারামারি আর বকা খেয়েই বেড়ে উঠছিল শিশুটি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল নিজেকে সব কিছুর জন্য দায়ী ভাবা ছোট্ট শিশুটি। এই শিশুটিই ছিল লিওনার্দা।
সৌভাগ্যক্রমে লিওনার্দা বেঁচে যায়। ১৯১৭ সালে এক রেজিস্ট্রি অফিসের ক্লার্ককে বিয়ে করেন তিনি। এই বিয়েতে তার বাবামায়ের একেবারেই সম্মতি ছিলনা। তারা লিওনার্দার বিয়ে ঠিক করেছিল এক ধনী ব্যক্তির সঙ্গে। এই বিয়েকে কেন্দ্র করে লিওনার্দার বাবা মা তার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং লিওনার্দার বিয়েকে তারা অভিশপ্ত বলে ঘোষণা করেন। লিওনার্দা কখনো শান্তি পাবেনা, এমন অভিশাপও দেয় তারা। বিয়ের পর লিওনার্দা স্বামী নিয়ে স্থায়ী হন করেজিয়ো নামের এক মফস্বলে।
লিওনার্দা তার বৈবাহিক জীবনে মোট ১৭ বার গর্ভবতী হন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, তা গর্ভজাত মাত্র ৪ জন সন্তান জীবিত ছিল। বাকিদের অনেকেই গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন মারা গেছে অথবা শৈশবেই অকালে ঝরে গেছে। লিওনার্দা তার বাড়ির পাশে একটি ছোট্ট দোকান চালাতেন এবং তার ছেলেমেয়েরা তাকে সাহায্য করতো। তিনি ছিলেন তার সন্তানদের ভালোবাসায় অন্ধ। কাউকে তিনি এক মূহুর্তের জন্য চোখের আড়াল করতেন না। কিন্তু চিত্রপট পালটে যেতে লাগলো যখন শুরু হলো ২য় বিশ্বযুদ্ধ।
লিওনার্দার সবচেয়ে বড় ছেলের নাম ছিল জিসেপি। সে ছিলো তখন টগবগে যুবক। অন্যান্য তরুণ ইটালিয়ানের সে ও ইটালিয়ান সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণ করতে চাইল। তখনই লিওনার্দার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরল! জিসেপি ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। তাকে হারানোর আশঙ্কায় লিওনার্দার ঘুম হারাম হয়ে গেলো। সে অনেক চেষ্টা করেছিল জিসেপিকে থামানোর। তবে সে ছিল তার মায়ের মতোই জেদি এবং একরোখা।কারো কথা না শুনে চলে গেলো যুদ্ধে।
অন্যদিকে সন্তান হারানোর চিন্তায় লিওনার্দা তখন পাগলপ্রায়। হঠাৎ একদিন তার মাথায় এলো, প্রাণের বদলে উৎসর্গ করতে হবে প্রাণ। জিসেপির প্রাণ বাঁচানোর জন্য তাকে বলি দিতে হবে অন্য কোনো প্রাণ। যে সে প্রাণী হলে চলবে না, মানুষের বদলে মানুষের প্রাণই উৎসর্গ করতে হবে! লিওনার্দার এলাকার নারীরা তাকে খুব পছন্দ করতো। লিওনার্দাকে ধার্মিক এবং সৎ বলেই জানতো সবাই। তারা বিশ্বাস করতো যে লিওনার্দার কিছু আধ্যাত্মিক ক্ষমতা রয়েছে। পাশাপাশি সে একটি হোটেলও চালাতো।
তার প্রথম শিকার ছিল ফস্টিনা নামের এক মধ্যবয়স্ক নারী। ফস্টিনা লিওনার্দাকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি লিওনার্দার কাছে আসতেন দুটি শান্তির, ধর্মের কথা শুনতে। আর এই ফস্টিনাকেই টার্গেট করলেন লিওনার্দা। লিওনার্দা ফস্টিনাকে বললেন যে তিনি ফস্টিনার জন্য একজন বিবাহযোগ্য পাত্র খুঁজে পেয়েছেন। পাত্র তারই আত্মীয়, সে ফস্টিনাকে বিবাহ করতে আগ্রহী। তবে পাত্র থাকে ‘পুলা’ শহরে। ফস্টিনাকে যেতে হবে সেখানে। তখনকার দিনে এমনটা প্রায়ই হতো।
ফস্টিনা সরল মনে বিশ্বাস করলেন সবকিছু। লিওনার্দা তাকে এও বললেন, বিয়ের কথা যেন কেউ জানতে না পারে। তাহলে লোকের কুনজরে ভেস্তে যাবে সব। তিনি বললেন যাওয়ার আগে যেন ফস্টিনা পোস্টকার্ডে করে লিখে সবাইকে সবকিছু জানিয়ে যায়। তাহলে সবাই নিশ্চিন্তে থাকবে। ফস্টিনা তাই করল। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিল, আত্মীয় স্বজনদের নামে পোস্টকার্ড পোস্ট করে গেলো, সেখানে লেখা ছিল পুলা তে তার হবু স্বামীর কথা। যাওয়ার আগে সে দেখা করতে গেলো লিওনার্দার সঙ্গে। সেটাই হলো তার কাল।
বিকেলবেলা লাগেজ নিয়ে লিওনার্দার বাড়ি গেলো ফস্টিনা, সেখান থেকে সোজা স্টেশনে যাবে সে। লিওনার্দার বাচ্চারা তখন বাইরে খেলছে। ফস্টিনাকে ঘুমের ওষুধ মেশানো রেড ওয়াইন খাওয়ালেন লিওনার্দা। তারপর তার অচেতন দেহটিকে নিয়ে গেলেন বেজমেন্টে। সেখানে কুঠার দিয়ে আলাদা করে ফেললেন ফস্টিনার মাথা। তাজা রক্ত জমা করলেন একটি ডিশে। তারপর দেহটিকে নয় টুকরা করলেন। তারপর চুলোতে বিশাল এক হাড়িতে ফস্টিনার গায়ের মাংস চর্বিগুলো কস্টিক সোডা দিয়ে সেদ্ধ করে হাড়গুলো তুলে ফেলেন এবং সেগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলেন। গোশত চর্বি গলে যখন পুরো মিশে গেলো, তারপর মিশ্রনটা সেপটিক ট্যাঙ্কে ঢেলে দেন। । সেখানে যখন সাবানটা জমাট বাঁধলে, কেটে টুকরো টুকরো নেন। তারপর জমাট বাঁধা রক্তগুলো ওভেনে একটু বেক করে রক্তের পানি শুকিয়ে ঝরঝরে করে ওতে একে একে ময়দা, চিনি, চকলেট, ডিম, দুধ এবং মার্জারিন মিশিয়ে খুব ভালো করে মিশিয়ে খামির বানিয়ে তা থেকে টি কেক বানান। সেই টি কেক তিনি দোকানে বিক্রি করেছেন, মেহমান এবং ঘরের লোকদেরও খেতে দিয়েছেন।
নিজের বিকৃত কাজের কথা এভাবেই নিজেই ব্যাখ্যা করেন লিওনার্দা।
লিওনার্দা তার ২য় শিকার ছিলেন ফ্রাঞ্চেসকা ক্লিমেনটিনা সোভি, তৃতীয় ভিক্টিম ছিল গরীব বিধবা ভার্জিনিয়া ক্যাসিয়োপো। তাদেরকেও চাকরির লোভ দেখিয়ে ফাঁসানো হয়।
তবে লিওনার্দার ভাষায়, অন্যন্য ভিক্টিমদের চেয়ে ভার্জিনিয়া বেশ ভালো ছিল। অন্যদের মৃতদেহ থেকে সাধারণ গন্ধবিহীন সাবান বানালেও ভার্জিনিয়ার মৃতদেহ থেকে তিনি বানিয়েছিলেন সুগন্ধী সাবান! ভার্জিনিয়ার গায়ে চর্বি বেশি থাকায় সাবানগুলো খুব “ক্রিমি” হয়েছিল। টি কেকগুলোও নাকি ছিল চমৎকার! তার ভাষায়, ভার্জিনিয়া খুব “মিষ্টি” মেয়ে ছিল!
ভার্জিনিয়া নিখোঁজ হওয়ার পর দীর্ঘদিন তার খোঁজ না পাওয়ার তার ভাবী শরণাপন্ন হয় পুলিশের। তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে ভার্জিনিয়া ফ্লোরেন্সে নেই। ভার্জিনিয়ার ভাবী জানতো যে শহর ছেড়ে যাওয়ার আগে ভার্জিনিয়া দেখা করতে যাবে লিওনার্দার সঙ্গে। সে দেখেছিল ভার্জিনিয়াকে লিওনার্দার বাড়িতে ঢুকতে। ভার্জিনিয়ার ভাবী পুলিশ নিয়ে যায় লিওনার্দার বাড়িতে। পুলিশ যখন তাকে জিজ্ঞাসা করব ভার্জিনিয়ার কথা, লিওনার্দা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে সে খুন করেছে ভার্জিনিয়াকে। পুলিশ তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করে তাকে।
আদালতে সকল অপরাধ অকপটে স্বীকার করে লিওনার্দা। তার ছেলেমেয়েরা যেন দীর্ঘায়ু লাভ করে, তাই জন্যে সে নরবলি দিয়েছে। তার সন্তানের প্রাণের বদলে অন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছে সে। তার স্বীকারোক্তি এবং খুনের বর্ণনা শুনে আদালত তাকে মানসিক রোগী বলে আখ্যায়িত করে এবং তাকে মানসিক আ্যসাইনমেন্ট রাখার আদেশ দেয় এবং তাকে সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সেই সঙ্গে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় তাকে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় লিওনার্দা।
যে হাঁড়িতে তিনি তার ভিক্টিমদের সিদ্ধ করতেন, সেটি আজও ইতালির রোমে “ক্রিমিনোলজিক্যাল মিউজিয়াম” এ সংরক্ষিত আছে।
আমারসংবাদ/এডি
