Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

প্যারিস রোড ও উপাচার্য ভবন

মে ৬, ২০২১, ০৪:৪৫ পিএম


প্যারিস রোড ও উপাচার্য ভবন

অনেকের দৃষ্টিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের এক লীলাভূমি। গাছপালায় ভরা, পরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও স্থাপনাসহ এর আছে প্রায় ৩০৩ হেক্টর বিশাল দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস। এই ক্যাম্পাসের বিউটি হলো 'প্যারিস রোড'। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের কাছে এ রোডটি শুধু প্রিয় নয়, অনেক দর্শনার্থী এটি দেখার জন্য ঢু মারে এবং দিন দিন তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৯৬৫ সালে তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর এম শামসুল আলম ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য  ফ্রান্স থেকে 'গগন সিরিস' নামে ৬০০ গাছের চারা ক্রয়ের ব্যবস্থা করেন। পরে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর নাদিরুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি দল প্যারিস রোডের দুই পাশে গগন সিরিসের চারাগুলো লাগান। যেহেতু রাস্তাটি দেখতে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের একটি রাস্তার মতো তাই তখন থেকে এর নামকরণ করা হয় প্যারিস রোড।

প্যারিস রোডের সাথেই আছে বিশাল এলাকা জুড়ে উপাচার্য ভবন। অনেকটা হোয়াইট হাউসের আদলে। ভবনের চারিচহর গাছপালা দিয়ে সুসজ্জিত। ভবনের সামনে যেমন আছে নারকেল গাছ ঘেরা পুকুর, তেমনি অন্যদিকে আছে ফুলে-ফলে ভরা নানা জাতের গাছ-পালা।

এতসব সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাবি হাতে চার বছর পরপর একজনকে পাঠানো হয় উক্ত ভবনে। দায়িত্ব দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু সামলিয়ে রাখতে।

গত ২০১৭ সালের ৭ই মে এ চাবি দেওয়া হয় বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর আব্দুস সোবহানকে এবং সেই চাবি হস্তান্তর হওয়ার কথা আগামী ৬ই মে, ২০২১। বিগত প্রায় চার বছরে আমাদের ধ্যান-ধারনাই পরিবর্তন হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় সামলানো নামে তার কার্যকলাপে। নিজের ইচ্ছেমতো আইন-কানুন বানিয়ে এবং আত্বয়ীকরণের মাধ্যমে প্রাণের এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তিনি আদমজী জুট মিল বানিয়েছেন।

অযোগ্যকে যোগ্য বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশকে তিনি ধ্বংশ করে দিয়েছেন। মাছের পচন ধরে মাথা থেকে। উপাচার্য প্রফেসর আব্দুস সোবহান এ পচন মাথা থেকে লেজে নিয়ে গিয়ে ঠেকিয়েছেন।

শুনেছি ভিসি হলে অনেক 'কমপ্রোমাইজ' করতে হয়, 'রাজনীতিবিদ' হতে হয়। কিন্তু কতটুটু! সম্প্রতি যে কায়দায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ রাতে চুরি এবং দিনেদুপুরে ডাকাতি হচ্ছে তা কোন সভ্য দেশে হতে পারে না।

যাদের হাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন এবং টম-জেরি খেলছেন বলে অনেকে মনে করেন।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের প্রমাণিত আকাম ও কর্মকান্ড পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না উচ্চশিক্ষার এ কারখানায়। গলদ কি উপাচার্য নিয়োগে? বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় উপাচার্য নিয়োগের প্যানেল করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হচ্ছে তাতেই মনে হয় এ গলদ থেকে যাচ্ছে।

আমাদের শুনতে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকে সিভি নিয়ে যে যার মতো মন্ত্রী, এমপি এমনকি ঠিকাদারদের কাছ থেকেও ডিও লেটার নিয়ে শিক্ষামন্ত্রালয়ে জমা দিয়ে আসছেন।

বিভিন্ন সোর্স থেকে জানা যাচ্ছে, শিক্ষামন্ত্রালয়ও ক্লান্ত এসব তদবিরে। সম্প্রতি প্রফেসর ড. এস এম এক্রাম উল্ল্যাহ যথার্থই লিখেছেন সমকালে (২৭/০৪/২০২১)। তিনি লিখেছেন, উপাচার্য হওয়ার জন্য অনেকে নিজের যোগ্যতাকে যথেষ্ট মনে না করে বাবা, ভাই, মামার মতো লোকজনকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে অথবা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে সামান্যতম কুন্ঠাবোধ করছেন না।

অথচ এসব পদে কেমন ব্যক্তিরা আসবেন তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর সময়ে শ্রদ্বেয় শিক্ষকদের খুঁজে বের করে উপাচার্য হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। কেউ অপারগতা প্রকাশ করলে বঙ্গবন্ধু বার বার তাঁকে অনুরোধ করে রাজি করিয়েছেন।

'৭৩ অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনেটর দ্বারা উপাচার্য প্যানেল গঠনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের কথা বলা আছে এবং বর্তমানে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেইভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সিনেটর দ্বারা নির্বাচিত হয়ে উপাচার্য হলে শিক্ষক তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি উপাচার্যদের একটা দায়বদ্ধতা থাকে।

আবার যেসব বিশ্ববিদ্যালয় '৭৩ অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না সেক্ষেত্রে ভিসিদের যোগ্যতা নির্ধারণ জরুরী হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে আমার সুস্পষ্ট মতামত। সরকারের পক্ষ থেকে ভিসি পদে আবেদনপ্রার্থীদের যোগ্যতা নির্ধারণপূর্বক শিক্ষামন্ত্রালয়ের ওয়েবসাইটে অনলাইনে প্রাথমিক আবেদনের সুযোগ থাকতে হবে যাতে আগ্রহীরা সবাই আবেদন করতে পারেন।

এরপর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় শিক্ষামন্ত্রালয় একটা সার সংক্ষেপ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠাবেন। সেখান থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাচাই-বাচাই করে একজনের নাম মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর সুপারিশ করবেন।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় উপাচার্য হওয়ার জন্য সিভি শিক্ষকদের নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরা খুবই অশোভন ব্যাপার। আরও অশোভন লাগে যখন শোনা যায় সম্ভাব্য প্রার্থীর জন্য অনেক সময় একেকটা সিন্ডিকেট দাঁড়িয়ে যায় এবং বিভিন্ন শর্তে তাদের সাথে দফারফা হয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাঁচান। দু-চারটি ছাড়া অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় সঠিকভাবে চলছে না। আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আর গর্ব করতে পারছি না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু রাজনীতিবিদদের হাতে যেমন দেশ চালানো দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তেমনি গবেষণায় ও পড়ালেখায় যারা পন্ডিত ছিলেন তাদের দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর দায়িত্ব। যারা স্পষ্টভাষী, শক্ত মানুষ, যারা অন্যায়ের সাথে আপোস করেন না, তারা ভিসি হতে পারেন না- এ ধারণা ভেঙ্গে দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আপনার পিতার পথ অনুসরণ করুন। তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাঁচতে পারে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টিনন্দন ও চাকচিক্য যে উপাচার্য ভবন আছে তার ভেতরটা সৌন্দর্যমন্ডিত করে দেন সাদামনের মানুষ, গবেষণায় ও শিক্ষকতায় সর্বজনস্বীকৃত একেকজনকে দায়িত্ব দিয়ে। কেবল ভেতরের আলোই পারবে প্যারিস রোডের মত রোডকে আলোকিত এবং সৌন্দর্যমন্ডিত রাখতে। এটা আপনার জন্য কঠিন ব্যাপার না।

লেখক-
ড. আসাবুল হক
প্রফেসর, গণিত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

আমারসংবাদ/এআই