Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

ফিরলেন মৃত্যুর মুখে : আজ আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ

আসাদুজ্জামান আজম

আসাদুজ্জামান আজম

মে ১৭, ২০২২, ০১:৩৭ এএম


ফিরলেন মৃত্যুর মুখে : আজ আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ

অনিশ্চিত গন্তব্য, তাক করে আছে শত্রুর বন্দুক। অবরুদ্ধ গণতন্ত্রে অস্থির রাজনীতি। এমনই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে ১৯৮১ সালের আজকের দিনে (১৭ মে) স্বদেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দেশে ফিরেই জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হন। দীর্ঘ ৪১ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের এ পথচলায় তিনি বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। 

বিশ্লেষকদের মতে, দেশে ফিরে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা, জাতির পিতার রক্ত, স্বপ্ন, দ্রোহ আর বেদনা বুকে ধারণ করে হয়েছেন বাঙালির বিশ্বজয়ের স্বপ্নসারথি। আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা। একজন শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই কারণেই আজকের বাংলাদেশ। দেশের বাইরে প্রশংসিত হয়েছে তার সাহসিকতা ও মানবতার রাজনীতি। একুশ শতকের অভিযাত্রায় বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় উন্নয়নের একমাত্র কাণ্ডারি হিসেবে বিবেচিত করা হয় তাকে। 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এনেছিলেন বাঙালির স্বাধীনতা, আর তিনি কঠিনতম পথ পাড়ি দিয়ে এনেছেন বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি। সততায় বিশ্বের শীর্ষ তিন রাষ্ট্রপ্রধানের একজন শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক সংস্থা প্যারাডাইস পেপার্স, পানামা পেপার্স, পিপলস অ্যান্ড পলিটিকস, বিশ্বের পাঁচ সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করেছে, যাদের কোনো দুর্নীতি স্পর্শ করেনি। এদের বিদেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টও নেই, উল্লেখ করার মতো কোনো সম্পদও নেই। বিশ্বের সবচেয়ে সৎ এই পাঁচ সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যার পাহাড়সম অর্জনের পেছনের গল্পটা মসৃণ নয়। সে পথ  ছিল কণ্ঠকাকীর্ণ ও বিপদসঙ্কুল। 

১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর যখন কালো অন্ধকারে ঢাকা পুরো বাংলাদেশ, জাতিকে দিকনির্দেশনা দেয়া নেতৃত্বদানকারীরা কেউ মৃত, কেউ কারাগারে অথবা কেউ বিভ্রান্ত।  ঠিক এমনি ক্রান্তিলগ্নে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বকে ভয় পায় ঘাতকগোষ্ঠী। তৎকালীন সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে না দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। সব বাধা উপেক্ষা করে দীর্ঘ ছয় বছর নির্বাসন শেষে ১৯৮১ সালে ১৭ মে কালো অন্ধকারে ছেয়ে থাকা দেশকে আলো দেখাতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হাজির হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। শত্রুর তাক করা বন্দুক উপেক্ষা করে নামেন বাঙালির ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। দেশের মানুষের মুক্তির স্বপ্নের মূর্ত প্রতীক হয়ে ঘুমন্ত, ক্লান্ত, বিপর্যস্ত জাতিকে আবার স্বপ্ন দেখাতে চষে বেড়ান সারা দেশ। 

দীর্ঘ ২১ বছরের লড়াই সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে আসেন রাষ্ট্রক্ষমতায় জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণে, উন্নত-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণে হয়ে উঠেন অক্লান্ত-নির্ভীক সৈনিক। সেদিন রাজধানী ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা শহর মিছিল আর স্লোগানে প্রকম্পিত হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টিও সেদিন লাখ লাখ মানুষের মিছিলকে গতিরোধ করতে পারেনি। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর পরিণত হয় জনসমুদ্রে। 

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখতে সেদিন সারা বাংলাদেশের মানুষের গন্তব্য ছিল রাজধানী ঢাকা। স্বাধীনতার অমর স্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম— পিতৃ হত্যার বদলা নেবো’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে— আমরা আছি তোমার সাথে’। ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’।

দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার, বঙ্গবন্ধুহত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঝড়-বাদল আর জনতার আনন্দাশ্রুতে অবগাহন করে শেরেবাংলা নগরে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’ 

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’ 

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে পরদিন ১৯৮১ সালের ১৮ মে দৈনিক ‘সংবাদ’ ‘লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্যদিয়ে বরণ করে নেয় তাদের নেত্রীকে’ শিরোনামে লিখে— রাজধানী ঢাকা গতকাল (১৭ মে) মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টিও মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি। স্লোগানেও ভাটা পড়েনি। লাখো কণ্ঠের স্লোগান নগরীকে প্রকম্পিত করেছে।’ সংবাদ আরো লিখে, বিকেল সাড়ে ৪টায় আকাশে যখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি দেখা যায় তখন সকল নিয়ন্ত্রণ আর অনুরোধ আবেদন অগ্রাহ্য করে হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে যায়। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই বিমানটি অবতরণ করে। জনতা একেবারেই বিমানের কাছে চলে যায়। বহু চেষ্টার পর জনতার স্রোতকে কিছুটা সরিয়ে ট্রাকটি ককপিটের দরজার একেবারে সামনে নেয়া হয়। এই সময়ে শেখ হাসিনা ভেতর থেকে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন।

বেলা ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা সিঁড়ি দিয়ে ট্রাকে নেমে আসেন। এই সময় লাখো জনতার কণ্ঠে ছিল গগনবিদারী স্লোগান— ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম— মুজিব হত্যার বদলা নেবো’। এ সময় অনেকের চোখে ছিল অশ্রুধারা। যখন তাকে মালা পরিয়ে দেয়া হয়, তখন শেখ হাসিনাও অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন। এ সময় শেখ হাসিনার পরনে ছিল সাদা রঙের ওপর  কালো ডোরাকাটা তাঁতের মোটা শাড়ি ও মাথায় ঘোমটা। কুর্মিটোলা থেকে শেখ হাসিনার শেরেবাংলা নগরে এসে পৌঁছতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। এ সময় ঝড়-বৃষ্টিতে নগর জীবন প্রায় বিপন্ন। রাস্তাঘাট স্বাভাবিক জীবন যখন ব্যাহত তখন এখানে অপেক্ষা করে কয়েক লাখ মানুষ। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তিনি গণসংবর্ধনা মঞ্চে উপস্থিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। 

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর যখন প্রবঞ্চক বিশ্বাসঘাতক খুনি দেশদ্রোহীরা প্রিয় মাতৃভূমিকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলেছিল— আমাদের জাতীয় জীবন যখন জাতিদ্রোহীদের অত্যাচারের প্রচণ্ড দাবদাহে বিপর্যস্ত তখন বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল শ্রাবণের বারিধারার মতো— পাহাড় সমান বাধা জয়ের অনন্ত অনুপ্রেরণা। এরপর দীর্ঘ ৪১ বছরের রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরশাসনের অবসান, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বাঙালির ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। খাদ্যে স্বয়ংস্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের নরঘাতক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্যতা, নিষ্ঠা, মেধা-মনন, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে এক সময় দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত যে বাংলাদেশ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করত সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলছে। বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তালাবিহীন ঝুঁড়ির অপবাদ ঘুচিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে উন্নয়নে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হতে পেরেছে। বাংলাদেশ আজ দ্রুত বর্ধমান পাঁচটি অর্থনৈতিক দেশের মধ্যে একটি। একসময় দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলেছে। আশঙ্কা করা হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতিতে দেশে হাজার হাজার মানুষ অনাহারে মারা যাবে। কিন্তু সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের কারণে একজন মানুষও অনাহারে মারা যায়নি। বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হলে বাংলাদেশ হবে আধুনিক রাষ্ট্র। 

পিতা মুজিবের আদর্শে স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল হয়ে উন্নত দেশে পরিণত করার দুর্গম পথের অভিযাত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় আওয়ামী লীগ সভাপতির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দেশের সকল মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। 

একই সাথে মন্দির, প্যাগোডা, গির্জাসহ সকল উপাসনালয়ে দেশব্যাপী বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করবে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া বোল ১১টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা বক্তব্য রাখবেন। গতকাল সোমবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যুবলীগের উদ্যোগে আলোচনা সভা ও বাক-প্রতিবন্ধী, শ্রবণ-প্রতিবন্ধী এবং দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীদের মাঝে শাড়ি লুঙ্গি ও সাদাছড়ি বিতরণ করা হয়।

Link copied!