Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

 নীরব ঘাতক উচ্চ রক্তচাপ

মাহমুদুল হাসান 

মাহমুদুল হাসান 

মে ১৭, ২০২২, ০২:২৫ এএম


 নীরব ঘাতক উচ্চ রক্তচাপ

আজ উচ্চ রক্তচাপ দিবস। দেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ২১ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগছেন। তাদের মধ্যে ৮৯ শতাংশই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না। আবার আক্রান্তদের অর্ধেকই জানেন না, তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। ফলে তারা দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত ও চিকিৎসাবিহীন থাকেন। এতে করে তাদের স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। করোনা মহামারির কারণে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের ঝুঁকি এখন বেশি। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। আর এই রোগে প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ৭৬ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ অসংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণ করে। যার মধ্যে দুই লাখ ৭৭ হাজার মৃত্যু হূদরোগজনিত। আর হূদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। 

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, উচ্চ রক্তচাপের কারণে স্ট্রোক, হাইপারটেনসিভ  এনসেফালোপ্যাথি,  প্যারালাইসিস, মস্তিষ্কে জটিলতা, মস্তিষ্কের সাব অ্যারাকনয়েড স্পেসে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। এ ছাড়া হূৎপিণ্ড বড় হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক ও ফেইলিউর, করোনারি হার্ট ডিজিজ প্রভৃতি হতে পারে। এটি চোখেরও বিভিন্ন ক্ষতি করে থাকে। যেমন হাইপারটেনসিভ রেটিনোপ্যাথি, দৃষ্টিশক্তির ব্যাঘাত, প্যাপিলিডিমা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, উচ্চ রক্তচাপ সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। বিশেষ করে নিয়মিত হাঁটা, সাঁতার কাটা, ব্যায়াম করতে হবে। যারা ধূমপান করেন তাদের ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। অধিক পরিমাণে গরু-ছাগলের মাংস ও তৈলাক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। শাক-সবজি-ফলমূল ইত্যাদি বেশি করে খেতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। কারণ মনে রাখতে হবে, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চেয়ে উচ্চ রক্তচাপের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশি। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত প্যানেল উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসার জন্য একটি জাতীয় প্রটোকল এবং একাধিক ওষুধের সমন্বয়ে একটি কার্যকরী ডোজ নির্ধারণ করেন। এই প্রটোকল অনুসারে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় দেশের ২০০টি উপজেলা হাসপাতালের এলসিডি কর্নার থেকে বিনামূল্যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে।

 এর মধ্যে ৮০টি উপজেলায় ওষুধ বিতরণের পাশাপাশি ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগীদের তথ্য সংগ্রহ, নিবন্ধন ও ফলোআপ করা হচ্ছে। সিলেট বিভাগ, কিশোরগঞ্জ ও জামালপুর জেলার ৫৪টি উপজেলায় রোগীদের স্ক্রিনিং, নিবন্ধন, ফলোআপ ও ওষুধ বিতরণের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ। এই উপজেলাগুলোয় এখন পর্যন্ত সাত লাখ ২৬ হাজার ৯০০ মানুষের স্ক্রিনিং করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯১ হাজার ৬৯১ জনের উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত ও নিবন্ধন করা হয়েছে। এই নিবন্ধিত রোগীদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের হার ৫৭ শতাংশ। 

বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে-২০১৮ অনুযায়ী, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ২১ শতাংশ (নারী ২৪ দশমিক এক শতাংশ, পুরুষ ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত এবং এদের মধ্যে ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে মাত্র ১৪ শতাংশ, যা প্রতি সাতজনে একজনেরও কম। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮ অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৭-১৮ সাল সময়ের মধ্যে ৩৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। 

পুরুষের মধ্যে ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশে এবং নারীর ক্ষেত্রে এ হার ৩২ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা রয়েছে এমন নারী এবং পুরুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার যথাক্রমে ৪৯ শতাংশ এবং ৪২ শতাংশ, যেখানে স্বাভাবিক ওজনের নারী এবং পুরুষের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ২৫ শতাংশ এবং ২৪ শতাংশ। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অর্ধেক নারী (৫১ শতাংশ) এবং দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষই (৬৭ শতাংশ) জানে না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই (৬৪ শতাংশ) কোনো ওষুধ সেবন করে না। এমনকি বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভি বলেন, বিশ্বজুড়েই উচ্চ রক্তচাপ একটি নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত। সাধারণ মানুষ উচ্চ রক্তচাপকে হাইপারটেনশন বা হাই ব্লাড প্রেসার নামেই জানে। এটি একটি জটিল শারীরিক অবস্থা। ধমনিতে রক্তপ্রবাহের চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের রক্তচাপ থাকে ১২০/৮০ মিলিমিটার অব মার্কারি। কারো রক্তচাপ ১৪০/৯০ মিলিমিটার অব মার্কারি বা এর চেয়ে বেশি হলে তার উচ্চ রক্তচাপ আছে বলে ধরে নেয়া হয়। 

গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘দেশে প্রতি পাঁচজনে একজনের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার যে তথ্য উঠে এসেছে, এটি খুবই ভয়াবহ। এই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আমাদের সবাইকেই সচেতন হতে হবে। সরকারের একার পক্ষে এই রোগ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।’

Link copied!