মো. মামুন মিয়া, মানিকগঞ্জ
অক্টোবর ২২, ২০২০, ০৮:০৬ পিএম
মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. হুমায়ন কবীর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে প্রসাশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কর্তব্যরত অবস্থায় প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে আসছেন সদর হাসপাতালের উল্টোদিকে অবস্থিত সেন্ট্রাল হাসপাতালে। নিয়মিত প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে আসার একপর্যায়ে গত বুধবার বিকেল ৫টার ক্যামেরাবন্দি হলেন ওই অর্থলোলুপ চিৎিসক।
মানিকগঞ্জ জেলাসহ অন্যান্য জেলার দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা অসংখ্য রোগী ও তাদের পরিবার-পরিজনের অভিযোগের ভিত্তিতে গণমাধ্যমকর্মীরা ঢুকে পড়েন সেন্ট্রাল হাসপালে হুমায়নের চেম্বারে। ঢুকার পর দেখা যায়, তিনি বসে রোগী দেখছেন।
এমন অবস্থায় তাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, আপনার উিউটি কোথায়?
তিনি বলেন, সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। তাহলে আপনি এখানে রোগী দেখছেন কিভাবে? কোনোমতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে অনেকটা চোরের মতো পালিয়ে যান অর্থলিপ্সু ডা. হুমায়ন। একই সময়ে সাংবাদিকদের আরেকটি টিম তথ্যানুসন্ধানে যান সদর হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে। সেখানে অবস্থানরত নার্স ও ঝাড়ুদারদের কাছে হুমায়নের অবস্থান জানতে চাওয়া হলে তারা গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, স্যার ওয়াশরুমে। অথচ তিনি ব্যস্ত প্রাইভেট প্র্যাকটিসে।
সূত্রে আরো জানা যায়, ডা. হুমায়ন সদর হাসপাতালে দায়িত্ব চলাকালীন সময়ে, রোগীর ভর্তির ফরম ও রোগ বৃত্তান্তের ফরমে রোগীর নাম ঠিকানা ও রোগের বর্ণনা না লিখে অগনিত খালি ফরমে স্বাক্ষর করে চলে যান প্রাইভেট প্র্যাকটিসে। যেকোনো ধরনের রোগী ভর্তি হতে এলে দায়িত্বরত নার্স ও ইন্টার্নি ডাক্তাররা সেই ফরম ফিলাপ করে রোগী ভর্তি করে।
বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে আবাসিক চিকিৎসক ও তত্ত্বাবধায়ককে জানালে তারা ছুটে আসেন জরুরি বিভাগে। এসে ডা. হুমায়নকে না পেয়ে তারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। এমন সময় হুমায়ন সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে দৌড়ে চলে আসেন ডিউটিতে, পড়েন রোগীদের রোষানলে।
ভুক্তভোগীরা জানান, বাড়তি আয়ের প্রত্যাশায় মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের বেশির ভাগ চিকিৎসক হাসপাতালে রোগী দেখতে চান না। হাসপাতালে সেবা পেলে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বারোটা বেজে যাবে। তাই অসংখ্য রোগী বিশেষ করে শিশু রোগীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা পাওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।
সূত্র জানায়, ডা, হুমায়ন সরকারি চিকিৎসক হলেও তিনি বেশি সময় ব্যয় করেন সেন্ট্রাল হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতাল থেকে ফুসলিয়ে রোগী নিয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালে যেতে বাধ্য করতে তার রয়েছে শক্তিশালী দালালচক্র। এই চক্রে বিশেষ পেশার কতিপয় অসাধু ব্যক্তি রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সূত্রমতে, সদর হাসপাতালে যোগদানের পর থেকেই হুমায়ন সেন্ট্রাল হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে আসছেন।
দিপালী সাহা নামের এক গৃহবধূ জানান, প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে এসেছি আমার ৯ মাস বয়সি কোলের শিশুর চিকিৎসার জন্য। কিন্তু ডা. সাহেব নাই। মধ্য বয়সি এক লোক বললেন, বেশি জরুরি হলে সেন্ট্রল হাসপাতালে যান। সেখানে হুমায়ন স্যার ৬০০ টাকার বিনিময়ে রোগী দেখেন।
দিপালী বললেন, আমার কাছে ২০০ টাকা আছে। তখন ওই দালাল বলে, টাকা ম্যানেজ করে নিয়ে আসনে। স্যারকে সারারাত পাবেন।
চিকিৎসার জন্য আসা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দিশারী ফাউন্ডেশনের সভাপতি হাসান শিকদার জানান, আজ সকালে আমি একজন মুমূর্ষু শিশুকে রক্ত দেয়ার জন্য রক্তদাতাকে নিয়ে হাসপাতালে আসি। সারা দিন চেষ্টা করেও একজন ডাক্তার পাইনি।
একপর্যায়ে ডা. হুমায়নের কাছে গেলে তিনি বলেন, সেন্ট্রাল হাসপালে যান। সরকারি ব্যবস্থাপনায় সেবা পেতে চাইলে তিনি ও তার সহযোগী দালালচক্র ক্ষেপে যায়। তাদের অসদাচরণে ফিরে আসি।
শিশু রোগীর অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিজ জেলায় অবস্থিত ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটি দুর্নীতি-অনিয়মে ভরা। চিকিৎসাসেবা নিতে আসা সাধারণ রোগীরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অথচ কর্তৃপক্ষ নীরব। এই পরিস্থিতির অবসান হওয়া জরুরি।
সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গড়পাড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আফসার সরকার বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এলাকায় এই বেহাল চিত্র সত্যি অবাক করার মতো। রোগীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হলেও হাতেগুনা কয়েকজন ছাড়া সব ডাক্তাররা আছেন প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ব্যস্ত। সেবা নয়, টাকা রোজগারই যেনো তাদের ব্রত হয়ে উঠেছে। সংবাদকর্মীদের সাহসী পদক্ষেপের জন্য তিনি ধন্যবাদ জানান।
আবাসিক চিকিৎসক ডা. এরফান বলেন, কর্তব্যরত অবস্থায় প্রাইভেট প্র্যাকটিস আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। দোষীদের বিরুদ্ধে অচিরেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। হাসপাতালের তত্ত্ব্বাবধায়ক ডা. আরশাদ উল্লাহ জানান, বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আমারসংবাদ/এসটিএম