Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

বর্ষায় শিশুর অপমৃত্যু ও করণীয়

খোন্দকার মাহ্ফুজুল হক

অক্টোবর ২২, ২০২০, ০৮:২৬ পিএম


বর্ষায় শিশুর অপমৃত্যু ও করণীয়

কোভিড-১৯-এর জরুরি পরিস্থিতি চলছে দেশে। স্কুল-কলেজ বন্ধ। অনেক শিশু-কিশোর দিনের পর দিন ঘরে আবদ্ধ। এ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে অনেকের মা-বাবা বাচ্চাদের নিয়ে ছুটছেন গ্রামে। গ্রামের বাড়িতে কাটাচ্ছেন দীর্ঘ ছুটি। তখনই ঘটছে মর্মান্তিক শিশু মৃত্যুর ঘটনাগুলো।

গবেষণায় দেখা গেছে, সারাবছর যতো শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়, তার প্রায় ৩৫ শতাংশ মারা যায় বিভিন্ন লম্বা ছুটির সময়।

‘সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ’-এর চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স ও চাইল্ড প্রোটেকশন সেক্টরের মতে, সড়ক দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। বছরের বিশেষ সময়ে এ মৃত্যুর হার বেশি।

গত ১০ জুলাই থেকে ২২ জুলাই বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৭৬, এর মধ্যে ৬০ জন শিশু। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডিজাস্টার ফোরাম এ তথ্য প্রকাশ করেছে।

এছাড়াও এ বছর বর্ষা মৌসুমে ২০৬ জন শিশু এ পর্যন্ত মারা গেছে। মেয়ে শিশু ৮৬ এবং ছেলে শিশুর সংখ্যা ১২০ জন মর্মে তাদের প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর ওপর ২০১৭ সালে এক গবেষণা চালায়।

এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এটা পাঁচ বছরের কম বয়সি মোট শিশু মৃত্যুর প্রায় ৪৩ শতাংশ।

জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা তথ্যে শিশু পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রচুর জলাশয়-পুকুর, নদী, ডোবা, খাল, বিল রয়েছে। দেশের বাস্তবতায় সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো পুকুর। বর্ষায় এগুলো টইটম্বুর থাকে।

তাদের গবেষণা মতে, পানিতে ডুবে ৬০ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে সকাল নয়টা থেকে দুপুর একটার মধ্যে। আমাদের দেশের বাস্তবতাও তাই। কেননা এসময় শিশুদের মা বা তত্ত্বাবধায়করা ঘরকন্না বা অন্য কাজে বেশি ব্যস্ত থাকেন।

সাধারণত পানির প্রতি শিশুদের একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে। এ আকর্ষণই তাদের পুকুর বা জলাশয়ের কাছাকাছি নিয়ে যায়। পুকুর বা জলাশয়ে ঢিল ছোঁড়া, মাছ ধরা, পানিতে নেমে খেলা করা, কাগজের খেলনা তৈরি করে পানিতে ভাসানো ইত্যাদি কারণে পানিতে ডোবার ঘটনাগুলো ঘটে। পা পিছলে পুকুর বা জলাশয়ে পড়ে যাওয়াও অন্যতম একটি কারণ।

বন্যার সময় ঘুমের মধ্যে শিশু পানিতে পড়ে যাওয়ার ঘটনাও অনেকসময় ঘটতে দেখা যায়। দুর্ঘটনার শিকার হওয়া শিশুর ক্ষেত্রে একটু বড় শিশুরা উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেও মারা যাচ্ছে। নৌ দুর্ঘটনায়ও শিশু মারা যায়।

আমাদের দেশে ডুবে যাওয়া মানুষের চিকিৎসার কোনো প্রটোকল বা বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা প্রক্রিয়া তৃণমূল পর্যায়ে ধারাবাহিক প্রচার ও অনুসরণ নাই বললেই চলে। অপ্রিয় সত্য তথ্য হচ্ছে, পানি থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত ঘোষণা করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।

বর্ষায় শিশু অপমৃত্যুর আরেকটি কারণ বজ পাত। বজ পাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারা দেশের একটি নতুন দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বড়দের পাশাপাশি এতে শিশুদেরও মৃত্যু ঘটছে। ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যমতে, গত ৯ মাসে সারা দেশে বজ পাতে ৩২টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

এর মধ্যে জুনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ঝড়-ঝঞ্চার সময় নিরাপদ স্থানে না থাকা, এ সময় খোলা স্থানে-ছাদে-মাঠে খেলাধুলা করা, বিদ্যুৎ বা বজ  সংবেদনশীল বস্তুর সংস্পর্শে আসা, চলাচল সীমিত না রাখা, বজ পাত বিষয়ে সঠিক ধারণা ও সচেতনতা না থাকার ফলেই এ মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটছে।

বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি ও বন্যায় জনপদ প্লাবিত হয়ে যায়। এতে অনেক সময় সাপের বাসস্থান বিনষ্ট হয়। ফলে সাপ এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে। অসতর্ক অবস্থায় শিশুরা অজান্তেই তাদের মুখোমুখি হয় এবং দংশনের শিকার হয়। বর্ষা মৌসুমে তাই শিশু অপমৃত্যুর অন্যতম আরেকটি কারণ সাপে কাটা।

এর হার ক্রমেই বাড়ছে। এর কারণ হলো শিশুকে সাপে কাটার পর প্রাথমিক চিকিৎসা না নেয়া। এর বদলে ওঝা-বদ্যিকে ডাকা হয়। নিকটস্থ হাসপাতালে যেখানে এর চিকিৎসা আছে সেখানে নেয়া হয় না। এটা ঘটছে অসচেতনতা এবং প্রচারণার স্বল্পতার কারণে।

বর্ষায় এছাড়াও পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া, কলেরার মতো অন্যান্য কিছু ব্যাধিতেও শিশু অপমৃত্যু ঘটছে। ঠাণ্ডাজনিত রোগগুলোতো থাকছেই এর সাথে। কখনো কখনো তা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাশে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কয়েক ঘণ্টার দুর্যোগের কবলে পড়ে প্রায় এক লক্ষ আটত্রিশ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। যার ৫০% ছিলো শিশু। এছাড়াও নদী ভাঙন, বন্যার পানির স্রোতসহ প্রাকৃতিক অন্যান্য দুর্যোগেও শিশুর অপমৃত্যু ঘটছে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ও শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী শিশু সুরক্ষা অধিকার এবং উন্নয়নে বাংলাদেশ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এর ধারাবাহিকতায় সরকারের ভিশন ২০২১-এ শিশুর সুরক্ষিত ও নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে সরকার তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় পিইএইচডি ফাউন্ডেশন পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধকল্পে শিশুদের সাঁতারের প্রশিক্ষণ প্রদান করে যাচ্ছে।

 এছাড়াও সরকার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২০২০) গণসচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক যোগাযোগ ও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে শিশুকে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা, প্রশিক্ষণ, বিপদকালীন সময়ে সকল শিশুর সুরক্ষা, উদ্ধার ও নিরাপত্তা বিধান, স্বেচ্ছাসেবী ও শিশুর মায়েদের উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ ইত্যাদি নানাবিধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এসব কর্মসূচি বর্ষায় শিশু অপমৃত্যুর হার কমাতে সহায়ক হচ্ছে।

বর্ষায় শিশু অপমৃত্যু রোধে সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ মৃত্যুর হার কমাতে পারে। পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের সার্বক্ষণিক তদারকিতে রাখা, শিশুকে চোখে চোখে ও হাতে হাতে রাখা, সাঁতার শেখানো, বাড়ির পাশের পুকুর, ডোবা, জলাশয়, ড্রেন ইত্যাদিতে শিশুর ঝুঁকি কমানোর মতো সহজ ও নিরাপদ অবকাঠামো গড়ে তোলার বিষয়ে নাগরিক দায়িত্ব সচেতনতা পালন করতে হবে।

বন্যা, দুর্যোগ বা প্রাকৃতিক সৃষ্ট যেকোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে শিশুকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পানিতে ডোবা, বজ পাত, সাপেকাটা, পানিবাহিত ও ঠাণ্ডাজনিত রোগ ইত্যাদি বিষয়ে বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে সকল মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে।

দুর্যোগ ও ঝড়-ঝঞ্চার সময় শিশুদের নিরাপদ স্থানে রাখা, চলাচল সীমিত রাখা এবং মাঠে বা ছাদে খেলতে দেয়া নিরুৎসাহিত করতে হবে। বড়রা বর্ষা মৌসুমে শিশুদের চোখের আড়াল না করার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সাপে কাটলে ওঝা-বদ্যি নয় দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

ইউনিসেফের তথ্যমতে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর সর্বোচ্চ হার বাংলাদেশে। তাই এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে সচেতনতা ও সুরক্ষামূলক কার্যক্রমই একমাত্র উপায়। যার মাধ্যমে বর্ষায় শিশু অপমৃত্যুর হার আমরা কমিয়ে আনতে সক্ষম হবো।

 [পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার]

আমারসংবাদ/এআই