Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

বস্তিতে আগুন থেরাপি!

নভেম্বর ২৪, ২০২০, ০৬:১৫ পিএম


 বস্তিতে আগুন থেরাপি!

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রায়ই বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ সময়ই সেসব অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানা যায় না। তদন্ত কমিটি হলেও জানা সম্ভব হচ্ছে না অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ। অনেকেই বলছেন, বস্তিগুলোতে আসলে আগুন লাগে না, লাগানো হচ্ছে।

আবার কেউ কেউ বলছেন, বস্তিতে পরিকল্পিতভাবে লাগানো এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বস্তি পুড়ছে না, পুড়ছে মূলত বস্তিতে বিদ্যমান হাজারো স্বপ্ন। অথচ নদী ভাঙনের মতো ভয়াবহ ট্রমা নিয়েই বস্তিবাসীদের অধিকাংশ বাসিন্দা বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে বস্তিতে মাথা গুঁজছেন। খড়কুটোর অবলম্বনে বস্তি নামক মায়াপুরীতে আসছেন বাঁচার জন্য! কিন্তু সেখানে বাঁচার কোনো রাস্তাই থাকছে না। একদিন নদীর মতই আগুন কেড়ে নিচ্ছে তাদের স্বপ্ন।

পোড়া বস্তিতে থেকে যাচ্ছে শুধুই অসহায় বস্তিবাসীর নির্বাক চাহনি। আরও কিছু থাকে কি? হয়তো থাকে নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন। একটু আশ্রয় আর দুবেলা খাবার জোটানোর আশা। তাতে ভর করে পুনরায় শুরু করেন নতুন কর্মযজ্ঞ।

কিন্তু সেটাও খুব বেশি স্থায়ী হচ্ছে না। তার আগেই রহস্যময়ী আগুনের শিখা স্বপ্ন পোড়াতে দাউ দাউ করে জ্বলেওঠে। এভাবেই নিরন্তর চলছে বস্তিবাসীর জীবন। তবুও স্বপ্ন দেখা ফুরোয় না বস্তিবাসীদের।

সোমবার মধ্যরাত আর মঙ্গলবার বিকালের আগুনে শতাধিকেরও বেশি ঘর পুড়েছে রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তি ও মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লায়। অভিজাত গুলশান নিকেতনের পশ্চিম পাশের ওই এলাকায় সোমবার মধ্যরাতে ঘটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।

আগুন লাগার কারণ ও ক্ষতির মাত্রা তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট রাত পৌনে ১২টার দিকে খবর পেয়েই আগুন নেভাতে কাজ শুরু করে। পরে রাত ১২টা ৫৫ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

জানা গেছে, যেখানে আগুন লেগেছে, বস্তি এলাকা হলেও সেখানে বেশকিছু পাকা বাড়ি ছাড়াও একটি বাজার রয়েছে। আগুনের শিখা অনেক দূর থেকেও দেখা যাচ্ছিল। কয়টি ঘর পুড়েছে- ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট কেউই তার সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেনি। এছাড়া বস্তিতে কত সংখ্যক ঘর ছিলো তাও নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি এখনো। যদিও কেউ কেউ ধারণা করে বলছেন, দেড় থেকে দুইশ ঘর পুড়েছে।

সাততলা বস্তির আগুন নিয়ে আলোচনার শেষ না হতেই মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বিহারী পট্টির জহুরি মহল্লায়ও হানা দেয় স্বপ্ন পোড়ানো আগুন। ফায়ার সার্ভিস সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিক নিয়ন্ত্রণে জন্য দশটি ইউনিট পাঠায়।

গতকাল বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে এ আগুন লাগে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কন্ট্রোল রুমের অপারেটর জিয়াউল হক। তিনি বলেন, বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে বিহারী পল্লীতে আগুন লাগার খবরে ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। তবে আগুন লাগার কারণ ও কোনো হতাহতের খবর দিতে পারেননি এই অপারেটর।

কিছুক্ষণ পর আবার যোগাযোগ করা হলে আরেক অপারেটর আনিসুর রহমান বলেন, আগুনের ব্যাপকতা বেশি। ফায়ার সার্ভিসের আরও তিনটি ইউনিট পাঠানো হয়েছে। ১০টি ইউনিট কাজ করছে। প্রায় ৪৫ মিনিটের চেষ্টায় বিকাল পাঁচটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। তবে আগুনের সূত্রপাত আর ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেনি তারা।

সম্প্রতি কল্যাণপুরের নতুন বাজার বস্তিতেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। যে ঘটনায় ৫০টিরও বেশি ঘর পুড়ে যায়। দগ্ধ হয় দুই বাসিন্দা। ওই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সূর্যের মুখ দেখেনি। যে কারণে জানা যায় না আগুন লাগার প্রকৃত কারণ। জানা যাচ্ছে না এসব অগ্নিকাণ্ড উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কী না।

তবে বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের ৯ মার্চ রাজধানীর কড়াইল বস্তিতেও আগুন দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ বস্তিটিতে আগুন দেয়া হয়। ২০১৬ সালের ৪ ডিসেম্বরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় প্রায় ৫০০-র বেশি ঘর।

একই বছরের ১৪ মার্চ পোড়ে বস্তির অর্ধশত ঘর। ওই বস্তিটির জমির মূল মালিক বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। তারা আদালতের আদেশ নিয়ে ২০১২ সালে কড়াইলে জমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা শুরু করে।

প্রথম দিনের অভিযানে ৪০০টি ঘর উচ্ছেদ করা গেলেও দ্বিতীয় দিন হাজারো বস্তিবাসী গুলশান-মহাখালী এলাকার সড়কে নেমে ওই এলাকা কার্যত অচল করে দেয়। পরে আর তাদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। এত কিছু করেও যখন কিছু হলো না, তখনই কড়াইল বস্তিতে আগুন থেরাপির সূত্রপাত হয় বলে ধারণা করেন বস্তিবাসীরা। তাদের আর্তনাদে উঠে আসে পরিকল্পিতভাবে বারবার আগুন দেয়ার অভিযোগ।

কল্যাণপুরের পোড়াবাড়ি বস্তিতে ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি আগুন দেয়া হয়। ওই জমির মালিক হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্স ইনস্টিটিউট। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞায় উচ্ছেদ অভিযানে ব্যর্থ হয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তায় বস্তির একটি অংশে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে।

বস্তি উচ্ছেদের ওই আগুনে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতেও বাধা দেয়া হয়। বস্তিগুলোতে যে ঘন ঘন আগুন লাগছে এসব ঘটনার একটা বড় অংশের পেছনে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র রয়েছে। জমি ফিরে পেতে পূর্ব কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই রাজনীতির আশ্রয়ে পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হয়।

এতদিন যখন বস্তির ভাড়ার টাকা পকেটে ঢুকেছে, তখন কেন তাদের অন্যত্র স্থানান্তের সুযোগ না দিয়ে আগুনের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে— তৎকালীন সময়ে এমন প্রশ্নই ছিলো সবার।

এদিকে অনেক বস্তিতেই দেখা যায় পুড়ে যাওয়ার পর সেখানে অন্য কোনো স্থাপনা তৈরি হয়। আবার অনেক জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের পর বস্তিতে নতুন ঘর উঠলেও দেখা যায় মালিকানা বদলে যায়। নিরীহ মানুষের স্বপ্ন পুড়িয়ে নির্দিষ্ট মহল ব্যবসার প্রসার করছেন। আগের দখলদারদের স্থলে নতুন দখলদার চলে আসেন।

বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, রাজধানীসহ সমগ্র দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থাকতেও তাদের কাজের সমন্বয়হীনতার কারণেই বস্তিবাসীদের প্রতিনিয়ত স্বপ্ন পোড়ানো আগুনের মুখে পতিত হতে হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।

বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে বিশিষ্ট কলামিস্ট, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী আবুল মকসুদ আমার সংবাদকে বলেন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার। অবসরপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ যারা আছেন তাদের মাধ্যমে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দরকার। সমস্যা হচ্ছে- অতীতের কোনো ঘটনার সঠিক তদন্ত হয়নি।

কি কারনে আগুনের ঘটনা ঘটছে সে কারণটা খুঁজে বের করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে কে কি বললো না বললো সেটা দিয়ে প্রমাণ হবে না। সেজন্য সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার, নিরপেক্ষ লোক দ্বারা তদন্ত হওয়া দরকার- বস্তিতে কেন এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড বারবার ঘটছে।

আমারসংবাদ/এআই