Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

মামলায় পিছিয়েছে এনটিআরসিএর কাজ

নভেম্বর ২৪, ২০২০, ০৬:৫০ পিএম


মামলায় পিছিয়েছে এনটিআরসিএর কাজ

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) দিকে চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছেন লক্ষাধিক চাকরিপ্রার্থী। তবে শত শত মামলার জট ও করোনায় থমকে গেছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। প্রতিবছরই সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার কথা থাকলেও গেলো তিন বছরে একজন শিক্ষকও নিয়োগ দিতে পারেনি তারা।

যেখানে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার কথা প্রায় লক্ষাধিক, সেখানে কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাব ও মামলা জটিলতায় কোনো শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৩তম ব্যাচের চাকরিপ্রার্থীদের করা মামলার রায় আপিল বিভাগ থেকে চূড়ান্তভাবে দিলে মামলার সংখ্যা আরও বাড়বে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যাচের চার শতাধিক মামলার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেও কোনো কাজ হচ্ছে না বলেও জানান খোদ চেয়ারম্যান।

সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে নেয়া এনটিআরসিএর ১৩তম শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ চাকরিপ্রার্থীর মধ্য থেকে শূন্যপদের অনুকূলে ১৭ হাজার ২৫৪ শিক্ষার্থীকে পিএসসির আদলে তিন ধাপে পরীক্ষা নিয়ে বাছাই করে এ প্রতিষ্ঠান।

তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদও তার দেয়া এক বক্তব্যে বলেছিলেন, এনটিআরসিএ-এর পরীক্ষায় চাহিদা অনুযায়ী ১৫ হাজার চাকরিপ্রার্থীকে বাছাই করে স্কুলের নাম উল্লেখ করে তালিকা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি শুধু তাদের যুক্ত করে নেবেন।

এর বাইরে তাদের আর কোনো কাজ নেই। কিন্তু পরবর্তীতে তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে জটিলতা তৈরি এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে ৮০ শতাংশ নিয়োগ পাওয়ার কথা। পরবর্তীতে এই ৮০ শতাংশের মধ্যে যারা যোগদান করতে পারবে না সেই সংখ্যক পদে পরবর্তী ২০ শতাংশের মধ্য থেকে উত্তীর্ণদের ওই পদে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে সুপারিশ করা হবে।

কিন্তু এ নিয়ম অনুসরণ না করেই পরবর্তীতে ১৪তম ব্যাচের পরীক্ষা নিয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার সুযোগে ২০১৭ সালে এক দফা শিক্ষক নিয়োগ দেয় এনটিআরসিএ। এরপর থেকে এ পর্যন্ত আর কোনো শিক্ষক নিয়োগ চূড়ান্ত করতে পারেনি এই প্রতিষ্ঠান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান মো. আকরাম হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, কাজ করার সুযোগ কোথায়। শুধু ঢাকাতেই চার শতাধিক মামলা রয়েছে। মামলাগুলো আমাদের কাজের গতি পিছিয়ে দিচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ রেখার মধ্য থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে এমন মামলার মুখোমুখি কেন এনটিআরসিএ?

এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, মামলা করার জন্য একটা সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এদের মূল কাজ হচ্ছে মামলা তৈরি করা। চাকরিপ্রার্থীদের নানাভাবে উস্কে দিচ্ছে এ সিন্ডিকেট। ঠুনকো বিষয়ে আদালতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এসব চাকরিপ্রার্থীদের।

এসব গ্রামপর্যায়ের সাধারণ সহজ সরল চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত তারা নিচ্ছে। আর এই টাকা দিয়ে কতিপয় আইনজীবী ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি করে ফেলেছে। এর বিরুদ্ধে এনটিআরসিএর কিছু করার আছে? এমন প্রশ্নও করেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, একদিকে মামলা করছে, অপরদিকে তারা চাঁদা আদায় করছে। এভাবে তারা (আইনজীবীরা) কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছে। এসব চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে কেউ আমাকে ফোন করলে আমি অনেককেই ধমক দিয়ে বলেছি তারা কেন এমন প্রলোভনের শিকার হচ্ছেন।

নিয়োগ প্রক্রিয়া কী হবে তা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করার পরও যথাযথ প্রক্রিয়ায় ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের চাকরিতে নিয়োগ না দেয়ার কারণেই এই মামলার প্রচলন শুরু হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এনটিআরসিএর সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) এবং সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মু. আ. আউয়াল হাওলাদার (অতিরিক্ত সচিব) বলেন, শুধু একটা ব্যাচের বিপরীতে কোনো প্রজ্ঞাপন দেয়া হয়নি। যৌথ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে সেখানে নির্দেশনা ছিলো।

এ পর্যন্ত ছয় লাখ ৩৪ হাজার শিক্ষার্থী এনটিআরসিএ থেকে পাস করেছে। যদিও এর মধ্যে অনেকের নিয়োগ হয়েছে। কোর্টের রায় অনুযায়ী কম্বাইন্ড মেরিট লিস্ট তৈরি করতে হবে। সেখান থেকে নিয়োগ দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। ১৩তম একটি মাত্র ব্যাচ।

যেহেতু কোর্টের রায়ে কম্বাইন্ড মেরিট লিস্ট তৈরি করতে বলা হয়েছে, তাই শুধু ১৩তম ব্যাচের চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগ দিতে গেলে রায়ের সঙ্গে কনফ্লিক্ট তৈরি করে। ফলে এখন কম্বাইন্ড মেরিট লিস্টের মধ্যে সবাই প্রবেশ করেছে। এজন্য আমরা রিভিউতে বলেছি একটি ব্যাচকে নিয়োগ দিলে বাকিরা মামলা করতে কোর্টে যাবে। এটা কি আদালত খেয়াল করেছে?

এক্ষেত্রে আদালতের রিভিউয়ে যদি পূর্ববর্তী রায় বহাল রাখে সে ক্ষেত্রে আপনাদের করণীয় কী হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তখন আমাদের স্ট্রাকচারালি অন্য চিন্তা করতে হবে। আমাদের ভেবে দেখতে হবে কোন উপায়ে এটার সমাধান করা যায়। তবে কোর্ট যা বলে সেটা তো মানতেই হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আরও ৫০-এর অধিক মামলা তৈরি হবে।

এসময় এনটিআরসিএর বর্তমান চেয়ারম্যান বলেন, এভাবে মামলা তৈরি হতে থাকবে সেখানে আমাদের করার কী? আমরা চাকরি করছি বেতন পাচ্ছি। লাখ লাখ সাধারণ চাকরিপ্রার্থী চাকরি পাচ্ছে না, সোজাকথা, এটা সাধারণ হিসাব। এসময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এসব মামলা-মোকদ্দমা না থাকলে এই মুজিববর্ষকে লক্ষ্য করে এই মুহূর্তে আমরা লক্ষাধিক চাকরিপ্রার্থীকে চাকরি দিতে পারতাম। মামলা জটিলতা না থাকলে পাস করা এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে এক লাখ আবেদনকারীকে চাকরি দেয়া যেতো। বাংলাদেশে এমন কোনো সংস্থা নেই যে তারা একই সময়ে এই সংখ্যক চাকরিপ্রার্থীকে চাকরি দেবে।

অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন বলেন, কিভাবে সম্ভব? আদালত কি আমাদের কথা শোনে?

নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা অসম্ভব। তাহলে এমন অচলাবস্থা কতদিন চলবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কী করার আছে? এটাই সিস্টেম। এখানে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই। এমনকি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই। আমরা মন্ত্রীকে অবহিত করেছি।

এদিকে এনটিআরসিএর দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোমিনুর রশিদ আমিনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি জানান, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কম্বাইন্ড লিস্ট করার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়াও আমরা এপিলেট (আদালতে) বিভাগে রিভিউ করেছি, এপিলেট ডিভিশন থেকে চূড়ান্ত রায়ের ওপর নির্ভর করে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। দেখুন এখানে একটি কম্বাইন্ড লিস্ট করতে বলা হচ্ছে।

একটা গ্রুপ হচ্ছে লিখিত পরীক্ষায় পাস করা, আরেকটা হচ্ছে মৌখিক পরীক্ষায় পাস করা এবং আরেকটি গ্রুপকে চাকরির ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়েছে এই তিনটাকে একসঙ্গে মিলানোর উপায় কী? এটা কি মিলানো সম্ভব? হাইকোর্টের দেয়া রায় অনেক বেশি জটিলতা তৈরি করেছে।

এনটিআরসিএ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে, এখন আদালত কী সিদ্ধান্ত দেয় তার ওপর বাকি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এপিলেট ডিভিশনের রিভিউয়ের সিদ্ধান্ত পাওয়ার আগে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়।

এদিকে যারা মামলা করেনি এরকম হাজারো চাকরিপ্রার্থী বলছেন, আমরা কেন এভাবে বসে থাকবো। বয়স তো শেষ হয়ে যাচ্ছে, এখনো চাকরির কোনো সমাধান নেই। তারা আরও বলছেন, শিক্ষামন্ত্রী যেনো বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখেন।

আমারসংবাদ/এআই