Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

স্বাস্থ্যের আরেক মালেক আক্তারুজ্জামান

নভেম্বর ২৫, ২০২০, ০৬:১০ পিএম


স্বাস্থ্যের আরেক মালেক আক্তারুজ্জামান

সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। সম্পদের পাহাড় গড়ার পাশাপাশি বিশেষ ক্ষমতারও অধিকারী হয়ে উঠছেন তারা। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও ডিঙিয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে।

জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার সঙ্গেও। আর গড়ে তুলেছেন নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড়। এমনি এক চতূর্থ শ্রেণির কর্মচারী পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের  প্রজেকশনিস্ট আক্তারুজ্জামান খান। যার কাজ ছিল রাস্তায় ঘুরে প্রজেক্টরের মাধ্যমে তথ্যচিত্র দেখানো।

স্বাস্থ্যের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী গাড়িচালক আব্দুল মালেকের পর ফের অঢেল সম্পদের হদিস পাওয়া এ কর্মচারীর। জানা গেছে, আক্তারুজ্জামানের দায়িত্ব ছিলো ঢাকা ও এর আশপাশের জনবহুল এলাকায় পরিবার পরিকল্পনা অধিপ্তরের বিভিন্ন কর্মসূচি প্রচার করা।

২০০১ সাল থেকে এ দায়িত্বের পাশাপাশি অফিসের নথিপত্রও দেখাশুনা করতেন তিনি। বিশেষ করে অফিসের নথিপত্র দেখাশোনার মধ্য দিয়েই খুলে যায় আক্তারুজ্জামানের কপাল।

কর্তৃত্বের প্রয়োগ শুরু করেন টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, জাইকা, ইউএনএফপি, ইউনিসেফ, বিকেএমআই, ইউএসএআইডি, ডব্লিউএইচওসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থ বরাদ্দেও। কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে সেসব সংস্থাকে কাজ পাইয়ে দিতেন তিনি।

এছাড়া টিভিতে প্রচারণামূলক একই নাটক-নাটিকা বছরের পর বছর প্রচার করে তুলে নিতেন মোটা অঙ্কের অর্থ। টিভি বিজ্ঞাপনে তুলনামূলক কম জনপ্রিয় কলাকুশলীদের দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরির মাধ্যমেও হাতিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের অর্থ।

এছাড়াও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বিলবোর্ডের মাধ্যমেও। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হলেও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আইইএম ইউনিটে ছিলো তার একচ্ছত্র আধিপত্য। তার দুর্নীতির প্রতিবাদ করা ব্যক্তিদের বদলি করা হতো ঢাকার বাইরে।

যদিও ২৬ বছরের চাকরিজীবনে তাকে বদলি হতে হয়নি একবারও। বরং অভিযোগের বোঝা মাথায় নিয়েই ছিলেন বহাল তবিয়তে। তবে সাংবাদিকদের পেট্রোনাইজ করা এ কর্মচারীর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রকাশ্যে আসায় এবং লক্ষ্মীপুরে বদলি করার ১০ মাসেও নতুন কর্মস্থলে না গিয়ে খোদ অধিদপ্তরের সঙ্গে ক্ষমতার দাপট দেখানোর চেষ্টাই কাল হলো তার।

শুধু তাই নয়, বদলি ঠেকাতে উচ্চ আদালতেও যান তিনি। বদলি ঠেকাতে হাইকোর্টে মামলাও করেন। যে মামলা আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ ও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছে বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা।

অন্যদিকে প্রশাসন তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজের জন্য বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করেছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা। এরপর থেকেই আক্তারুজ্জামান রয়েছেন আত্মগোপনে।  এদিকে বেরিয়ে আসছে তার অবৈধ সম্পদের তথ্যও।

এখন পর্যন্ত এ কর্মচারীর রাজধানীর মিরপুরের ১০ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের ২৭ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর প্লটে ছয় তলা বাড়ি, রোকশানা মঞ্জিল নামে ওই বাড়িতে ১২টি ফ্ল্যাট, একই এলাকার পাশের ৩১ নম্বর সড়কের ১১ নম্বর প্লটের অ্যাপার্টমেন্টের ছয় তলায় আরেকটি ফ্ল্যাট, পাশের ৩৩ নম্বর সড়কের ২০ নম্বর প্লটে রয়েছে একতলা একটি বাড়ি, পাশের টেক নামের এলাকায় একটি বাড়ি, মিরপুরের সেনপাড়ায় একটি প্লট, মিরপুরের হাজী আব্বাস উদ্দিন স্কুলের পাশে এভিনিউ ৫ এর ১৫ নম্বর লেনে দুই কাঠার একটি প্লট রয়েছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া বাড্ডা এলাকার সুবাস্তু টাওয়ারে ছেলে আসিফ খানের নামে একটি দোকান কিনেছেন আক্তারুজ্জামান। গাজীপুরের বোর্ড বাজারে তিন কাঠার একটি প্লট ও গাজীপুর সদরে তিন কাঠার একটি প্লট রয়েছে। আক্তারুজ্জামান চলাফেরা করেন নিজস্ব প্রাইভেটকারে।

তবে গাড়িটি (ঢাকা মেট্রো-গ-২৭-৩৯৬৯) তিনি শ্যালিকার নামে কিনেছেন বলে জানা গেছে।  

এছাড়াও একতলা আরেকটি বাড়ি কিনেছেন আক্তারুজ্জামান, যেটা আপাতত কারখানা হিসেবে ভাড়া দেয়া থাকলেও শিগগিরই সেখানে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। আক্তারুজ্জামানের এ সব অর্জনই তার ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে— বলছেন অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা, আর এ অর্জনে যেনো সংশ্লিষ্টদের চক্ষু চড়কগাছ।

এ ঘটনায় সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম আমার সংবাদকে বলেন, এদের পৃষ্ঠপোষক আছে। যে সম্পদ তারা অর্জন করেছে তার একটা অংশই কেবল তারা পেয়েছে, অন্যরাও তাদের দ্বারা লাভবান হয়েছে।

যারা দলে কিংবা রাজনীতিতে কিংবা সামাজিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির রোষানলে পড়ে কেবল তারাই প্রকাশ্যে আসছে, বিচার হচ্ছে, আইনের আওতায় আসছে। কিন্তু গডফাদাররা এর বাইরেই থেকে যায়।

জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আইইএম ইউনিটের প্রজেকশনিস্ট হিসেবে চাকরি শুরু করেন আক্তারুজ্জামান। গণেশ চন্দ্র সরকার নামে আইইএম বিভাগের সাবেক এক পরিচালকের মাধ্যমে বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত কর্মসূচির টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও অর্জন করেন বিপুল সম্পদ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আইইএম ইউনিটে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো আক্তারুজ্জামানের। আক্তারুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল থানাধীন নান্দাইল ইউনিয়নের আহমেদবাগ গ্রামে। তার বাবার নাম মো. মালেক। আক্তারুজ্জামানের বাবা একসময় গ্রামের বাড়ির পাশে টং দোকান করতো। কিন্তু বর্তমানে গ্রামের বাড়ির চারদিকে সীমানা প্রাচীর তুলে রেখেছেন।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, গত কয়েক বছরে আক্তারুজ্জামানের অস্বাভাবিক উত্থান হয়েছে। এক দশক আগেও এত সম্পত্তির মালিক ছিলেন না তিনি। আক্তারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ছুটিতে থাকা অবস্থায় অফিস সময়ের পর অফিসে ঢুকে নথিপত্র চুরি করার অভিযোগে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় যে সাধারণ ডায়েরি (নং-৩৩৪) করা হয়েছিল সেটিতে উল্লেখ করা হয়, প্রজেকশনিস্ট আক্তারুজ্জামান খান কার্যালয়ের সকল কার্যক্রমেই জড়িত ছিলেন।

তিনি আইইএম ইউনিটের কোটেশন, বিল ভাউচার তৈরি, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে বিল প্রেরণ ও বিলের বিপরীতে চেক গ্রহণের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দায়িত্ব পালনকালে তিনি নানা ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় তাকে সতর্ক করা হয়। তার কৃত অপরাধের আলামত নষ্ট করার জন্যই ছুটিতে থাকা অবস্থায় অফিস সময়ের পর অফিসে প্রবেশ করে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সংশ্লিষ্ট নথিপত্র, বিল ভাউচার সরিয়েছেন।

তেজগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক মাসুদুল হাসান বলেন, জিডির তদন্ত করতে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় আমলযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইইএম ইউনিট কর্তৃপক্ষকে মামলা করতে বলা হয়েছিল।

অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দুদক তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগের তদন্ত করছে। অভিযোগ তদন্ত শেষে দুদকই তার বিরুদ্ধে মামলা করবে। এ সংক্রান্ত সকল নথিপত্রও নিয়ে গেছে দুদক।

শুধু মালেক, আক্তারই নয়- স্বাস্থ্য খাতের আরেক তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আবজালও অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন পাহাড়সম সম্পদ। এ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড়ও সৃষ্টি হয়। স্ত্রীসহ গ্রেপ্তারও হয় আবজাল। তবুও থেমে নেই তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির এ কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য। একের পর এক বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

আমারসংবাদ/এআই