মোসাদ্দেকুর রহমান, জাবি
নভেম্বর ২৬, ২০২০, ০৬:০০ পিএম
শীতের বার্তা নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন করেছে অতিথি পাখি। লাল শাপলার জলাশয়গুলো তাদের কলকাকলি, জলকেলি আর খুনসুটিতে মুখর। ক্যাম্পাস এখন পরিযায়ী পাখিদের দখলে। করোনা মহামারিতে শিক্ষার্থীশূন্য ক্যাম্পাস যেনো তাদের আগমনে নীরবতা ভেঙেছে।
লাল শাপলার মাঝে অতিথি পাখির বাহারি খেলায় মেতে ওঠার দৃশ্য জানান দিচ্ছে গ্রাম বাংলার চিরচেনা রূপ। ক্যাম্পাসে ছোট-বড় আধভাঙা উঁচু ঢিবি আর জলাশয়ের পাড়ে অনেক সরালি ঝাঁক বেঁধে উড়ছে সাই সাই করে। আবার পরক্ষণেই ঝপাৎ করে বসে যাচ্ছে জলাধারে।
কোনোটি আবার সাঁতার কাটছে আপন মনে। শহরের ব্যস্ত জীবনের যান্ত্রিকতা-ধুলাবালুমুক্ত ক্যাম্পাসে পাখির ছোঁয়া পেতে প্রতিদিন দেখা যায় শত-শত পাখিপ্রেমীর ভিড়। সবুজ প্রকৃতি ও লাল দালানের রাজ্যে পাখিদের অবাধ বিচরণ মুগ্ধ করে দর্শণার্থীদের। এ সৌন্দর্য নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না।
এ বছর সেপ্টেম্বরের শেষ দিকেই পাখিরা আসতে শুরু করেছে। উত্তরের দেশ সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া ও নেপালে এই সময়টায় প্রচুর তুষারপাতের কারণে পাখিরা বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে আসে। তাই এসব অতিথিকে স্বাগত জানাতে নতুনরূপে সেজেছে লেকগুলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-বড় ২৬টি লেক থাকলেও পাখি আসে মূলত চারটি লেকে। শীত চলে গেলে তারাও চলে যায় তাদের আপন ঠিকানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনের জলাশয়, পরিবহন অফিস ও প্রকৌশল অফিস সংলগ্ন জলাশয়, ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের ভেতরের জলাশয় এবং সুইমিংপুল এলাকার জলাশয়ে অতিথি পাখির আধিক্য দেখা যাচ্ছে। জলাশয়গুলো বরবারের মতোই পাখির জন্য উন্মুক্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্যমতে, জাবির জলাশয়গুলোতে সর্বপ্রথম পরিযায়ী পাখি আসতে শুরু করে ১৯৮৬ সালে। তখন ক্যাম্পাসে লেঞ্জা হাঁস, গার্গেনি, সরালিসহ চার থেকে পাঁচ প্রজাতির পাখির দেখা মিলতো। পরে ৪০ থেকে ৫০ প্রজাতির পাখি এলেও গত কয়েক বছর থেকে এটা কমতে শুরু করেছে।
আরও জানা যায়, মূলত দুই ধরনের পাখির আগমন ঘটে এ ক্যাম্পাসে। এক ধরনের পাখি ডাঙায় বা শুকনো স্থানে বা ডালে বসে থাকে ও বিশ্রাম নেয়। আরেক ধরনের পাখি পানিতে থাকে। এদের বেশির ভাগই হাঁসজাতীয় ও পানিতে বসবাস করে। এরাই সবার নজর কাড়ে।
এর মধ্যে সরালি, পচার্ড, ফ্লাইফেচার গার্গেনি, ছোট জিরিয়া, পান্তামুখী, পাতারি, কোম্বডাক, পাতারি হাঁস, জলকুক্কুট, খয়রা ও কামপাখি অন্যতম। এ ছাড়া মানিকজোড়, কলাই, ছোট নগ, জলপিপি, নাকতা, খঞ্জনা চিতাটুপি, লাল গুড়গুটি, বামুনিয়া হাঁস, নর্দান-পিনটেল ও কাস্তে চাড়া প্রভৃতি পাখিও আসে এই ক্যাম্পাসে।
এ বছর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুল সংলগ্ন লেকটিতে প্রথম দেখা গিয়েছিল ছোট সরালি। তারপর একে একে আসতে শুরু করেছে অন্য প্রজাতিরা পাখিরা। ছোট সরালি, বড় সরালি, গার্গেনি, খুন্তে হাঁস এবং আফ্রিকান কোম্বডাক এই পাঁচ প্রজাতির পাখি এখন পর্যন্ত জাবির জলাশয়গুলোতে দেখা গেছে বলে জানান বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান।
তিনি বলেন, সব মিলিয়ে দুই থেকে আড়াই হাজার পাখি এসেছে। তবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পাখি আসে। সে হিসাবে আরও কিছু প্রজাতির পাখি আসতে পারে।
এসময় অতিথি পাখি ক্যাম্পাসে আসার প্রধান কারণ হচ্ছে— দেশের বাইরে থেকে এ সময় প্রচুর অতিথি পাখি হাওড় অঞ্চলগুলোতে আসতে থাকে। হাওড় অঞ্চলে পাখি শিকার হওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে পাখিরা।
তাই খাবার ও নিরাপত্তার কারণে পাখিগুলো শীতের শুরুতেই আমাদের ক্যাম্পাসে আসতে থাকে। প্রতি বছর জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে পাখি মেলার আয়োজন করা হয়। করোনা পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে এ বছরেও পাখি মেলার আয়োজন করা হবে বলে জানান তিনি।
করোনা পরিস্থিতিতে বহিরাগত বা দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। প্রতি বছর পাখির উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে থাকে সচেতনতামূলক প্লেকার্ড, পোস্টার ও লেকগুলো ঘিরে থাকে কাঁটাতারের বেড়া। কিন্তু এবার তেমন প্রস্তুতি চোখে পড়েনি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আ. রহমান বলেন, ক্যাম্পাস নীরব থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অনেক বেশি পাখি এসেছে। পাখিদের আবাসস্থল উপযুক্ত করতে ইতোমধ্যে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। তবে দর্শনার্থী না থাকায় ওদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
এরপরও শীঘ্রই জনসচেতনতামূলক নির্দেশিকা টানিয়ে দেয়া হবে। আরও যা যা দরকার, করবো আমরা। অতিথি পাখি আসার খবরে ক্যাম্পাসে বাড়ছে দর্শনার্থীদের ভিড়। শীতের সাথে সাথে অতিথি পাখির সংখ্যাও বাড়বে এমনই ধারণা পাখি বিশেষজ্ঞদের।
পাখির কিচিরমিচিরে যাদের ঘুম ভাঙতো আজ সেই শিক্ষার্থীরা নেই। করোনার গভীর সংকট দূর হয়ে নতুন ভোরের আলো ফুঁটবেই। করোনামুক্ত সেই সোনালি দিনের প্রতিক্ষায় শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা।
আমারসংবাদ/এআই