Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

বড় নেতাদের জোশ কমছে

আবদুর রহিম ও রফিকুল ইসলাম

নভেম্বর ২৭, ২০২০, ০৬:০০ পিএম


 বড় নেতাদের জোশ কমছে

বড় নেতারা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সশরীরে নেই। অসুখ-বিসুখে লম্বা সময় পার হচ্ছে। বার্ধক্য পেয়ে বসেছে অনেককে। এর মধ্যে প্রায় ৯ মাস দেশে করোনা পরিস্থিতি। জটিল রোগের কারণে শীর্ষদের অক্ষমতা আরো দীর্ঘ হচ্ছে। বড় পদের ব্যক্তিদের কর্মসূচিতে সশরীরে উপস্থিতির সক্ষমতা কম থাকায় নেতৃত্বের প্রভাব পড়ছে তরুণদের ওপর।

কার্যত রাজকৌশল, বুদ্ধি, পরামর্শের শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে সব দলেরই একই দৃশ্যপট। স্বীয় পদের পদমর্যাদা নষ্ট হলেও বয়স্করা তরুণদের পদ ছেড়ে দিচ্ছেন না। তরুণরাও দুঃসময়ে উঠে আসছেন না।

গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বায়োডাটা বিশ্লেষণে দেখা গেছে,  বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বয়স  ৮৮ বছর। করোনা নিয়ে দু-একটা মতামত গণমাধ্যমে দেখা গেলেও সশরীরে রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে তেমন দেখা যায়নি।

গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন ৮৪ বছরে পা রাখছেন। দলে ভাঙনসহ অনেক বড় ইস্যুতেও অন্যতম দেশীয় রাজনীতিতে প্রভাব রাখা ড. কামালকে ৯-১০ মাস রাজনৈতিক কর্মসূচিতে চোখে পড়েনি। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ৮৬ পার করেছেন। বয়স ও অসুস্থতার কারণে অনেক আগে থেকেই তিনি দৃশ্যত নেই। করোনা সময়ে প্রায় রাজনীতি থেকে হারিয়ে গেছেন। দলটির তরুণ প্রজন্মও জানে না তিনি এখন কেমন আছেন, দলের জন্য কী ভূমিকা রাখছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরুদ্দিন সরকারের  বয়স ৮৯। দীর্ঘদিন থেকে চলতে হয় অন্যের সাহায্য নিয়ে। করোনার আগে রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে এলেও টানা ২০-৩০ মিনিট একটানা দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকতে পারেন না।

আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদেরও বয়সও ৮০ পার হয়েছে। করোনা শুরু হওয়া পর থেকে বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত এই ব্যক্তিকে দেখা যায়নি।

দলটির মিডিয়া উইংয়ের ভাষ্য, করোনার পর থেকে তিনি কর্মসূচি ও নেতাকর্মী থেকে শারীরিক দূরত্ব ও সতর্কতা বজায় রেখে চলছেন।

আরেক শীর্ষ নেতা ড. আব্দুল মঈন খানের বর্তমান বয়স ৭৩ বছর। তিনিও দৃশ্যত কর্মসূচিতে সশরীরে পরিবারের চাপে আসতে পারছেন না।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বয়স ৭২। দেশের নানান ইস্যুতে বামপন্থি এই নেতাকে সবসময় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সরব থাকতে দেখা যেতো। করোনার ৯ মাসে স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছাড়া এই নেতাকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সশরীরে তরুণ প্রজন্ম পাননি বলে দাবি করছেন তারুণ্য রাজনীতির অনুসারীরা।

দেশের রাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত আরেক নেতা  কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। বয়স বেড়েছে তারও। পা দিয়েছেন ৭৪ বছরে। জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে বিএনপির সংসারে এসে সরব থাকলেও এখন সেই তেজ অনেকটা নিভে গেছে।

রাজনৈতিক ইস্যুতে নীরবতা। চুপচাপ করোনা সময়েও। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতারই বয়সের চাপে অতীতের রাজনৈতিক অবস্থান কমতে শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ এমপি।

বর্তমানে তার বয়স ৭৭ বছর। ভার্চুয়ালে কিছু কর্মসূচিতে সাময়িক ইস্যুতে কথা বলেও নেই সশরীরে। এই তালিকায় আরো রয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, যার বয়স ৮০ বছর।  সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ৭৯ বছরে পা রেখেছেন। আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য  সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এমপি, তিনিও ৮৫ বছর পার করেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তরুণদের জন্য বয়স্কদের রাজনীতি ছেড়ে দেয়াই উচিত। বর্তমানে সরকারি দলের বয়স্ক রাজনীতিবিদরা নিষ্ক্রিয়। মাঠের রাজনীতিতে তাদের কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। লন্ডন বা অন্য কোনো স্থান থেকে আসা হুকুমে পরিচালিত হচ্ছেন বিরোধী দলের বয়স্করা।

ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ স্বাধীন করলেও পুনর্গঠনে আমরা ব্যর্থ। ব্যর্থতার দায় নিয়ে আমাদের এখন রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার উপযুক্ত সময়। বয়স্করা রাজনীতি ছেড়ে দিলে তরুণদের মধ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না।

 গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিয়ম হচ্ছে নবীন-প্রবীণ নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনীতিতে নবীব-প্রবীণের সেই তৎপরতা দেখা যায় না। অনেকে এও মনে করছেন, প্রবীণরা দলীয় প্রোগ্রামে উপস্থিত না হলে রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না।

তরুণ নেতাকর্মীদের দাবি, যারা দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন; স্বাধীনতা-সারভৌমত্ব রক্ষায় ভূমিকা পালন করছেন; বয়সের ভারে অসুস্থতায় বিছানায় পড়ে আছেন— তারা যেনো তাদের বড় পদগুলো তরুণদের ছেড়ে দিয়ে দেশ ও মানুষের জন্য সুযোগ করে দেন। দলকে ব্যক্তি সম্পদে না রেখে দেশীয় সম্পদ মনে করে তরুণদের কাজ করার সুযোগ করে দেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এ নিয়ে আমার সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে সরকারি দলের বয়স্ক রাজনীতিবিদরা নিষ্ক্রিয়। মাঠের রাজনীতিতে তাদের কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। লন্ডন বা অন্য কোনো স্থান থেকে আসা হুকুমে পরিচালিত হচ্ছেন বিরোধী দলের বয়স্করা।

মূলত রাজনীতিতে বয়স্কদের সময় ফুরিয়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তরুণদের জন্য বয়স্কদের রাজনীতি ছেড়ে দেয়াই উচিত। কেউ কেউ ইতোমধ্যে ছেড়ে দিয়েছেন, তারা দলীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন না। এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ স্বাধীন করলেও পুনর্গঠনে আমরা ব্যর্থ। ব্যর্থতার দায় নিয়ে আমাদের এখন রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার উপযুক্ত সময়। বয়স্করা রাজনীতি ছেড়ে দিলে তরুণদের মধ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিয়ম হচ্ছে— নবীন-প্রবীণ নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনীতিতে নবীন-প্রবীণের সেই তৎপরতা চোখে পড়ে না।

অথচ রাজনীতিতে প্রবীণ এবং নবীন উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি আরও বলেন, ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রবীণ নেতাদের অভিজ্ঞতা এবং তরুণ নেতাদের সংগ্রামী চেতনার সমন্বয় না থাকলে যে লক্ষ্যে রাজনীতি তা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং হয়। কাজের প্রতিটি রাজনৈতিক দলে নবীনের পাশাপাশি প্রবীণ নেতাদের সক্রিয় হতে হবে। তাইলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সফল হবে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দলের রাজনীতিতে প্রবীণদের অংশগ্রহণ করাবে কি-না সেটি দলের বিষয়। আর প্রবীণরা দলীয় প্রোগ্রামে উপস্থিত না হলে রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, বর্তমান প্রতিটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল নেতারা মনে করেন, তরুণদের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে। তাই সবাই তরুণ নেতৃত্ব নিয়ে কাজ করছে।

আমারসংবাদ/এআই