Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা নিরসনে: ইছামতির পুনঃসংযোগে ১৩ দফা প্রস্তাবনা

কাজী নাসীর উদ্দীন, সাতক্ষীরা

ডিসেম্বর ১, ২০২০, ০৯:৫৫ পিএম


সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা নিরসনে: ইছামতির পুনঃসংযোগে ১৩ দফা প্রস্তাবনা

সাতক্ষীরা শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প কার্যকর করতে জেলা নাগরিক কমিটি দফায় দফায় নদী ও খাল খনন পূর্বক নদী-খালের নাব্য ফিরাতে ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে গত রোববার পুনরায় ১৩ দফা প্রস্তাবনা পেশ করেছে। সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামালের কাছে ওই প্রস্তাবনা পেশ করা হয়।

এসময় উপস্থিত ছিলেন— জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মো. আনিসুর রহিম, যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাড. শেখ আজাদ হোসেন বেলাল, সদস্য সচিব অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ, যুগ্ম সদস্য সচিব আলী নুর খান বাবুল, সদস্য শেখ বায়দুস সুলতান বাবলু, মাধব চন্দ্র দত্ত, অপারেশন পাল, জিএম মনিরুজ্জামান প্রমুখ।

উল্লেখ্য, গত ২ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের বৈঠকে ‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং- ১, ২, ৬-৮, ৬-৮ (এক্সটেনশন)-এর নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক ৪৭৫ কোটি ২৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সাতক্ষীরা শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর ৮১ কি.মি পুনঃখনন ও ড্রেজিং এবং ৮২টি খালে ৩৪৪.২২ কি.মি সংস্কার ও পুনঃখনন করা হবে।

এছাড়া ২৭টি রেগুলেটর ও স্লুইস গেট মেরামত, পুনর্গঠন, পুনরাকৃতিকরণ, ১১৩.১২ কি.মি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কার, বেতনা নদীর ডান তীরের ১.৭০ কি.মি ঢাল প্রতিরক্ষামূলক কাজ এবং চারটি আরসিসি ঘাটলা নির্মাণ করা হবে।

জেলা নাগরিক কমিটির প্রস্তাবনার ভূমিকায় বলা হয়েছে, গত ১০ বছরের মধ্যেই গৃহীত ওই প্রকল্পের অধিকাংশ কাজই পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, কর্মসৃজন প্রকল্প, ব্লুগোল্ডসহ বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু তার কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি, বরং পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে।

বিশেষ করে তিন-চারশ ফুট চওড়া বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর মাঝ বরাবর ৫০-৬০ ফুট খাল খনন করে নদী ভরাট করার কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
নাগরিক কমিটি এই পরিস্থিতি নিরসনের জন্য সাতক্ষীরা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত উজানের সাথে সম্পর্কযুক্ত একমাত্র প্রবাহমান নদী ইছামতির শাখা সাপমারা ও লাবন্যবতীর
স্লুইস গেট অপসারণ করে মরিচ্চাপ-খোলপেটুয়া ও অন্যান্য নদী-খালের জোয়ার ভাটার স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুজ্জীবিত করাসহ ১৩ দফা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা পেশ করেন।

প্রস্তাবনা সমূহ—
১. ইছামতি নদীর সাথে মরিচ্চাপ নদীর সংযোগ পুর্নস্থাপনে লাবন্যবতীর দুই মুখে স্থাপিত শাখরা-টিকেট এবং সাপমারার দুই মুখে স্থাপিত হাড়দ্দহা-কামালকাটি স্লুইস গেট অপসারণ অথবা দুই নদীর সরাসরি সংযোগ স্থাপনের জন্য স্লুইস গেটের পার্শ্ব দিয়ে বেড়িবাঁধ কেটে বিকল্প চ্যানেল তৈরি করতে হবে।

২. সাতক্ষীরা শহরের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত প্রাণসায়র খালের সাথে বেতনা নদীর পুনঃসংযোগ স্থাপনে খেজুরডাঙ্গী স্লুইস গেট এবং মরিচ্চাপ নদীর পুনঃসংযোগ স্থাপনে এল্লারচার স্লুইস গেট (বর্তমানে অস্তিত্বহীন) অপসারণ অথবা পার্শ্ব দিয়ে বেড়িবাঁধ কেটে বিকল্প চ্যানেল তৈরি করতে হবে।

৩. কোলকাতার খাল এবং শ্রীরামপুর-বাকাল খালের দুই মুখের সকল বাধা অপসারণ করতে হবে।

৪. ইছামতির পানি প্রবাহ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার আগেই লাবন্যবতী, সাপমারা, মরিচ্চাপ, কোলকাতার খাল ও শ্রীরামপুর-বাঁকাল খালের বেড়িবাঁধ যেখানে প্রয়োজন সেখানে উঁচু ও মজবুত করতে হবে এবং বিলের পানি নিষ্কাশনের জন্য খালের মুখে থাকা স্লুইস গেটগুলো সংস্কার করতে হবে। এছাড়া মরিচ্চাপ ও বেতনা নদীর সংযোগ স্থাপনকারী অন্যান্য খালগুলো উন্মুক্ত করে স্লুইস গেটগুলো সংস্কার করতে হবে। এজন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে না। নদী ও খাল খননের পরিধি ছোট করে ওই টাকার কিছু অংশ ব্যয় করলে কাজগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।

৫. প্রকল্পভুক্ত সকল নদী-খালের সিএস ম্যাপ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সীমানা পিলার স্থাপন করতে হবে। নদী ও খালের ম্যাপ তৈরির ক্ষেত্রে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

৬. প্রকল্পভুক্ত নদী-খাল খননের সকল মাটি নদী ও খালের সীমানার বাইরে অবক্ষেপণ করতে হবে। কোনো আবস্থাতেই নদী-খালের মধ্যে ডাম্পিং করে নদী বা নদীর পাড় ভরাট করা যাবে না।

৭. গ্রাম-শহরের বর্ষার পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রেখে মাছচাষের জন্য পরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট জোন সৃষ্টি করতে হবে। জোনের বাইরে কোনো মৎস্য ঘের করতে দেয়া যাবে না এবং নদী-খালের বেড়িবাঁধ ও সরকারি রাস্তাকে কোনোভাবেই মাছের ঘেরের বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়া যাবে না। বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টির পানি লোকালয় থেকে বিলে, বিল থেকে খালে এবং খাল থেকে নদীতে প্রবাহিত হওয়ার সময় তীব্র স্রোত সৃষ্টির মাধ্যমে নদীর প্রাকৃতিক খনন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে দেয়া যাবে না।

৮. শালিখা নদীর সাথে বেতনা নদীর পুনঃসংযোগ স্থাপনসহ প্রকল্পের বাইরে থাকা অন্যান্য নদীগুলোর আন্তঃসংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

৯. ইছামতি নদীর পানি প্রবাহ নিশ্চিত হওয়ার পর লাবন্যবতী, সাপমারা, কোলকাতার খাল, শ্রীরামপুর-বাঁকাল খাল, মরিচ্চাপ ও খোলপেটুয়া নদী খনন ছাড়াই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। সেক্ষেত্রে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত হলে আশাশুনির প্রতাপনগর, শ্রীউলা, খাজরা, আনুলিয়া এলাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত খোলপেটুয়া নদীর ভরাট প্রক্রিয়া বন্ধ হবে এবং এলাকা ভয়াবহ নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। ইছামতির ওই পানির আর একটি প্রবাহ কোলকাতার খাল ও শ্রীরামপুর-বাঁকাল খালের মাধ্যমে সাতক্ষীরা প্রাণসায়র খাল দিয়ে বেতনা নদীর জোয়ার-ভাটার সাথে সংযুক্ত হবে।

একইভাবে ইছামতির খোলপেটুয়া নদীতে জোয়ার-ভাটার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে বুধহাটার গাং দিয়ে বেতনা নদী প্রবাহমান হবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, স্লুইসগেট নির্মাণের পূর্বে ইছামতি এবং মরিচ্চাপ নদীর জোয়ার-ভাটার ব্যবধান দুই ঘণ্টা ছিলো। অর্থাৎ ইছামতিতে জোয়ার শুরু হলে সেই জোয়ারের পানি লাবন্যবতী-সাপমারা হয়ে মরিচ্চাপ-খোলপেটুয়া দিয়ে ভাটিতে প্রবাহিত হতো।

ঠিক একই প্রক্রিয়ায় খোলপেটুয়া-মরিচ্চাপে জোয়ার হলে সেই জোয়ারের পানি লাবন্যবতী-সাপমারা হয়ে ইছামতিতে ভাটি হতো। আবার কোলকাতার খাল, শ্রীরামপুর-বাঁকাল খাল দিয়ে ইছামতির জোয়ারের পানি সাতক্ষীরা শহরের প্রাণসায়র খাল দিয়ে বেতনা নদীতে গিয়ে ভাটিতে প্রবাহিত হতো। একই প্রক্রিয়ায় শালিখা, কপোতাক্ষসহ প্রকল্পের বাইরের এলাকায় জোয়ার-ভাটা হতো। এই আন্তঃসংযোগের কারণে নদী-খাল প্রবাহমান থাকায় পলি পড়ে ভরাট হওয়ার সুযোগ ছিলো না। কিন্তু আন্তঃসংযোগ বন্ধ করাতেই এবং অন্যান্য কারণে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

১০. ইছামতির পানিতে নদী-খালের এই স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করার পরও বেতনা অববাহিকার উজানে খুব বেশি প্রবাহ আগের অবস্থায় ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। ফলে সেখানে পলি পড়ে দ্রুত নদী ভরাটের আশঙ্কা থেকেই যাবে। এজন্য সুবিধাজনক স্থানে টিআরএম চালু করতে হবে। একই সাথে অন্যান্য নদী-খালের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার পর নিচু বিল উঁচু করতে এবং যেখানে পর্যাপ্ত স্রোত সৃষ্টি হবে না সেই সমস্ত এলাকায়ও টিআরএম চালু করতে হবে।

১১. নদী ও খাল খনন এলাকার জন্য মনিটরিং ব্যবস্থা করতে হবে।

১২. প্রকল্পের জন্য একটি টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপ তৈরি করতে হবে। তারা সাপ্তাহিক/মাসিক প্রতিবেদন দিবেন এবং এই সম্পর্কিত একটি ওয়েব সাইট তৈরি করতে হবে। যেখানে নাগরিকরা পরামর্শ ও মতামত প্রদান করবেন।

১৩. জেলা প্রশাসকের ঘোষণা অনুযায়ী ‘সকল নদী-খালের ইজারা বাতিল’-এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে।

সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা নিরসনে ইছামতির সাথে অন্যান্য নদীর পুনঃসংযোগ স্থাপনসহ ১৩ দফা প্রস্তাবনা পেশ করে জেলা নাগরিক কমিটি।

আমারসংবাদ/এসটিএম