Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

ভয়াবহ ভ্যাট জালিয়াতি অসাধু ব্যবসায়ীদের

জাহাঙ্গীর আলম

ডিসেম্বর ২, ২০২০, ০৬:০০ পিএম


ভয়াবহ ভ্যাট জালিয়াতি অসাধু ব্যবসায়ীদের

ভ্যাট দেয়ার নিয়ম থাকলেও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী তা মানছেন না। বিশেষ করে হোটেল-রেস্টুরেন্টের মালিকরা ভোক্তাদের কাছ থেকে হিসাব কষে ভ্যাট নিলেও রাজস্ব বোর্ডে জমা দিচ্ছেন না। ভোক্তাদের দেয়া রশিদ ফেলে দিয়ে ভয়াবহ চতুরতার আশ্রয় নিয়ে নকল ভ্যাটের কাগজ তৈরি করে জমা দিচ্ছেন রাজস্ব বোর্ডে।

এতে একদিকে ভোক্তারা ঠকছেন, অন্যদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরের অভিযানে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে অভিযানে গত চার মাসে ফুডপান্ডাসহ ৯০টি প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের ভ্যাট ফাঁকির সন্ধান মিলেছে।

ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের পরিমাণ প্রায় ১২শ কোটি টাকা। এই ফাঁকি রোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সম্প্রতি চালু করেছে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি)। আগামী জুনে সারা দেশে এক লাখ মেশিন বসানো হবে। মুজিববর্ষের কর্মসূচির অংশ হিসেবে পাইলট ব্যাসিসে ভ্যাট আদায়ে অনিয়ম বন্ধ করার জন্যই এই উদ্যোগ। এতে ভালোই সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।  

এনবিআর সূত্র মতে, সরকার দেশকে এগিয়ে নিতে প্রতি অর্থবছরে বড় আকারের বাজেট দিচ্ছে। এতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রাও বেশি করে ধরা হচ্ছে। এবারো এনবিআর থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মূসক বা ভ্যাট খাতে লক্ষ্য ধরা হয়েছে প্রায় এক লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ পেলেই ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করা ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছেন। অর্থাৎ ভ্যাট আদায় করে সঠিকভাবে জমা দিচ্ছেন না সরকারের কোষাগারে।

তাই ভ্যাট ফাঁকি ঠেকাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিশেষায়িত বিভাগ ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর খুবই তৎপরতা শুরু করেছে। তারা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছেন। অভিযান ছাড়াও বিশেষায়িত নিরীক্ষা ও তদন্তের মাধ্যমেও বেশ কিছু ফাঁকি ধরতে সমর্থ হয়েছে গোয়েন্দা বিভাগ।

ফুডপান্ডার মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকি : সম্প্রতি বান্দরবানের বিলাসবহুল সাইরু হিল রিসোর্টে অভিযান চালিয়ে প্রাথমিকভাবে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির বান্দরবানের ওই রিসোর্ট এবং ঢাকার বনানীতে প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে কম্পিউটার থেকে উদ্ধার করা তথ্যে এই ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পায়। ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মহিউদ্দীনের নেতৃত্বে বান্দরবানের চিম্বুক রোডে রিসোর্টটিতে অভিযান চালানো হয়।

একই সময়ে উপ-পরিচালক তানভীর আহমেদের নেতৃত্বে সাইরু হিল রিসোর্ট লিমিটেডের বনানীর কামাল আতার্তুক অ্যাভিনিউয়ের সফুরা টাওয়ারের ১৪ তলায় প্রধান কার্যালয়েও অভিযান চালানো হয়। অভিযানে গোয়েন্দারা ২০১৮ সাল থেকে রিসোর্টের প্রকৃত বিক্রয় তথ্য উদ্ধার এবং কম্পিউটার থেকে তথ্যাদি জব্দ করেন।

তাতে গত ১৫ নভেম্বর অভিযানে দেখতে পায়— প্রতিষ্ঠানটি অক্টোবর মাসের বিক্রি দেখায় ১১ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। এই বিক্রির ওপর ১৫ শতাংশ হিসেবে আদর্শ হারে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা মূসক পরিশোধ করেছে। আদর্শ হার ছাড়া বিক্রির চার লাখ টাকার ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে মূসক হিসেবে আরও ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

কিন্তু উদ্ধার করা তথ্যে দেখা যায়, ওই মাসে বিক্রি হয় এক কোটি ২৯ লাখ টাকা। ওই বিক্রির ওপর ১৫ শতাংশ হারে প্রদেয় মূসক ১৯ লাখ ৪৭ হাজার টাকা অর্থাৎ মূসকসহ মোট বিক্রি এক কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

এই হিসাব অনুসারে, কেবল অক্টোবর মাসে ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হয়েছে প্রায় ১৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। তদন্তে অন্যান্য মাসেও রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের ‘ভ্যাট ফাঁকি’র তথ্য পায় বলে জানায় ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর।

শুধু এখানেই নয়, গত অক্টোবরে দেশের অন্যতম অনলাইন খাবার সরবরাহকারী ফুডপান্ডার বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকিরও অভিযোগ পেয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর। অভিযানে তিন কোটি ৪০ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়ে ফুডপান্ডার বিরুদ্ধে মামলা করেছে অধিদপ্তর।

ভ্যাট ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ফুডপান্ডা বাংলাদেশ লিমিটেডে ভ্যাট গোয়েন্দার একটি দল ১৫ অক্টোবর আকস্মিক অভিযান পরিচালনা করে। ভ্যাট গোয়েন্দার উপ-পরিচালক নাজমুন্নাহার কায়সার ও সহকারী পরিচালক মো. মহিউদ্দীন অভিযানটা পরিচালনা করেন। তারা দেখতে পান, ফুডপান্ডা প্রায় পাঁচ হাজার প্রতিষ্ঠান থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে ভোক্তার কাছে সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট-সংক্রান্ত নথিপত্র দেখানো হয়।

তবে প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার তল্লাশিতে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ল্যাপটপে মাসিক বিক্রির কিছু গোপন তথ্য পান তারা। তাতে বাড়ি ভাড়া, উৎসে কর, জরিমানাসহ ফুডপান্ডা সব মিলিয়ে তিন কোটি ৪০ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে বলে জানায় ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর। এভাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ৯০টি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ১৮৮ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে বলে সূত্র জানায়।

ভ্যাট ফাঁকি রোধে ইএফডি : রাজস্ব আদায়ে বিশেষ করে ভ্যাট আদায়ে আগে ম্যানুয়াল পদ্ধতির পরিবর্তে এনবিআর ২০১২ সালে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার (ইসিআর) ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা মেশিন নিলেও পণ্য বা সেবা বিক্রির চিত্র তুলে ধরতেন না।

তাই এর সুফল পায়নি এনবিআর। কারণ এটা প্রতিষ্ঠানের সার্ভারের সাথে যুক্ত ছিলো না। অটো মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। তাই উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করে বিভিন্নভাবে পর্যালোচনা করে ইসিআরের পরিবর্তে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য গত আগস্টে চালু করা হয়েছে ইএফডি।

নতুন আইনে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ের জন্য ইএফডি মেশিন আগে বসানোর কথা থাকলেও করোনার কারণে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ইএফডি বসানো হয়েছে। ভ্যাটের অনিয়ম বন্ধ করতেই এই উদ্যোগ। এটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব আহরণে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছেন, ‘ইএফডি চালুর ফলে শুধু সরকারই লাভবান হবে তা নয়, ভোক্তারাও বুঝতে পারবেন তাদের দেয়া ভ্যাট সাথে সাথে সরকারের হিসাবে জমা হয়ে যাবে।

সেভাবে সার্ভার যুক্ত করা হয়েছে। ভ্যাটে অনিয়ম বন্ধে তদারকি করার জন্য ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১০০ মেশিন বসানো হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে সারা দেশে এক লাখ ইএফডি মেশিন বসানো হবে।

ইএফডি হলো আধুনিক হিসাবযন্ত্র। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দৈনিক লেনদেনের তথ্য তদারকিতে রাজস্ব বোর্ডের সার্ভারের সঙ্গে সফটওয়্যারের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকবে ইএফডি মেশিন। মূলত হোটেল, রেস্তোরাঁ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসহ সেবাখাতের লেনদেনের তথ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে ভ্যাটের হালনাগাদ তথ্য পেতে এই উদ্যোগ।

ইএফডি ও সেলস ডাটা কন্ট্রোলার (এসডিসি) ব্যবহার ও উপকারিতা সম্পর্কে অবহিতকরণের লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণে সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হচ্ছে। গতকালও রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সামারাই কনভেনশন সেন্টারে এ রকম একটি আয়োজন করা হয়।

হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ ২৫ সেবা খাতে ইএফডি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বলে আমার সংবাদকে জানান ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের  মহাপরিচালক ড. মইনুল খান।

 তিনি বলেন, ‘এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বচ্ছতা ফিরে আসবে। ভোক্তাদের প্রকৃত ভ্যাট সরকারের ঘরে জমা হবে।’  

ড. মইনুল খান বলেন, সেবা ও পণ্য সরবরাহকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ভোক্তাদের কাছ থেকে যে রশিদে ভ্যাট আদায় করে তা জমা দেয়ার কথা। কিন্তু আমরা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দেখছি, অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান তা করছে না।

তাই তাদের বিরুদ্ধে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন হচ্ছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কারণ যারা ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে তারা অন্যায় করছে। ভোক্তারা ভ্যাট দিলেও সরকারের ঘরে জমা হচ্ছে না। এক শ্রেণির অসাধু চক্র এ কাজটি করছে। ধরাও পড়ছে। অসম প্রতিযোগিতা যাতে সৃষ্টি না হয় সে জন্য অভিযান চলমান থাকবে বলেও জানান তিনি।    

আমারসংবাদ/এসটিএম