Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪,

প্রণোদনার ঋণ বিতরণে ব্যাংকের ঢিলেমি

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

ডিসেম্বর ৩, ২০২০, ০৬:১৫ পিএম


প্রণোদনার ঋণ বিতরণে ব্যাংকের ঢিলেমি

করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে তথা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকার গত এপ্রিলে এক লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। কিন্তু প্রায় আট মাস অতিবাহিত হলেও অর্ধেকও বিতরণ করা সম্ভব হয়নি।

ব্যাংকের মাধ্যমে এসব ঋণ বিতরণ করা হলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও কৃষি খাতের ঋণ বিতরণের অবস্থা খুবই ধীর। অর্ধেক, এটা কেন হয়েছে। কারো কাম্য নয়। নিয়ম ভেঙে এনজিও ২০ শতাংশেরও বেশি সুদ আদায় করছে প্যাকেজের ঋণে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

তাই এর কারণ খুঁজে দ্রুত ঋণ বিতরণ করতে তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘করোনায় ধাক্কা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী আর্থ-সামাজিক দিক বিবেচনা করে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। তারপরও কেন ঋণ বিতরণে ধীরগতি? অর্থ যাচ্ছে না কেন, দেখতে হবে।’

বিশেষ অতিথি ছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রণোদনার অর্থ বাস্তবায়নে তিনদিনের সিরিজ সভার দ্বিতীয় এ সভা গতকাল রাজধানীর ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার।

প্যানেক আলোচক ছিলেন, পরিকল্পনা কমিশনের জিইডির সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম, এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. মাসুদুর রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, সিপিডির ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ।

অর্থসচিব বলেন, ‘সরকার করোনা ভাইরাস সমস্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশবিশেষ অল্প সময়ে জরুরিভাবে মাত্র দুই মাসে ১০ হাজার ডাক্তার, নার্স ও হেলথ টেকনিশিয়ান নিয়োগ দিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় দুটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

আর সব শ্রেণিপেশার মানুষের কথা বিবেচনা করে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে এক লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা জিডিপির ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

তাতে ২১টি প্যাকেজ রয়েছে। কারো হাতে নগদ অর্থ, কাউকে ঋণ, ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে সবাই সুবিধা পান। কেউ বাদ না পড়ে। এসব বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন নীতি সহায়তা দেয়া হয়েছে। আট মাস চলে গেলেও ব্যাংকগুলো পুরো ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিলের মধ্যে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কৃষি ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র দুই হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

৪ শতাংশ সুদে ডিসেম্বরে পুরোটাই এই ঋণ বিতরণ করার কথা। সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে নিম্ন আয়ের মানুষদের তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার কথা। কিন্তু নভেম্বর পর্যন্ত এক হাজার কোটি টাকাও বিতরণ করেনি ব্যাংকগুলো। যারা কোনো সহায়তা পাননি তাদের জন্যও সরকার আড়াই হাজার টাকা করে পাঁচ লাখ মানুষকে অর্থ দেয়ার কথা।

কিন্তু গত মাস পর্যন্ত পেয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ। করোনায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু নভেম্বর পর্যন্ত তাদের ঋণ বিতরণ করা হয়েছে আট হাজার ২১৮ কোটি টাকা। গুরুত্বপূর্ণ খাত হলেও ব্যাংকগুলো অনীহা দেখিয়েছে। এর কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব দিলেও ঋণে গতি নেই কেন? কারা দায়ী এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থসচিব বলেন, ‘গৃহঋণ, বয়স্ক-ভাতাসহ কিছু প্যাকেজের সিস্টেম ও অবকাঠামোগত কারণে ঋণ বিতরণে দেরি হচ্ছে। ইন্স্যুরেন্সের ক্ষতি নিরূপণেও সময় লাগছে। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাই সব প্যাকেজের পুরো অর্থ ব্যয় করা হবে।’

এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ব্যাংকের শর্তের কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা প্রণোদনার সুযোগ পাচ্ছেন না। চার মাস চলে গেছে, ৫০ শতাংশও ঋণ বিতরণ  হয়নি। এর কারণ কি? সমস্যা কোথায়? অথচ তাদের ঋণ আদায় ভালো। তাই অর্থসচিবকে অনুরোধ করছি প্যাকেজ বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা নিন।’

সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী সব বিবেচনা করে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। ভালো উদ্যোগ। আট মাস চলে গেছে। তারপরও ঋণ বিতরণে ধীরগতি কেন? করোনা মোকাবিলায় কর্মসংস্থান খুবই জরুরি।

করোনায় অর্থনৈতিক সমস্যা, খাদ্য সমস্যা ও স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট হলেও গ্রামীণ অর্থনীতিই রক্ষা করেছে করোনা থেকে। তাই অষ্টম পঞ্চবার্ষিকীতে তা গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে বেশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। কারণ বর্তমানে অনেক ইয়ং যুবক কৃষিতে জড়াচ্ছে। তাদের প্রযুক্তির সহায়তা দিতে হবে।

মনমোহন প্রকাশ বলেন, করোনায় গ্রামের চেয়ে শহরে আক্রান্ত বেশি হয়েছে। বেকারও হয়েছে বেশি। তাই কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিতে হবে। ভালো উদ্যোক্তা তৈরির দিকে নজর দিতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যাতে প্রণোদনা প্যাকেজ পায় তা দেখতে হবে। করোনা শিক্ষা দিলেও প্রবাসী আয় ভালো অবস্থানে এসেছে। মানুষের সুস্বাস্থ্যের দিকে সরকার নজর দিতে হবে।’

শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, ‘প্রণোদনার এসএমই ঋণ কার্যকর করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করা হচ্ছে। এফবিসিসিআই বিভিন্ন চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের সাথেও যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে। তারপরও ঋণ বিতরণ কম। এর গতি বাড়াতে হবে।’

ড. শামসুল আলম বলেন, ‘করোনা সাপোর্ট প্যাকেজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি সব সেক্টরকে ছুঁয়েছে। স্বচ্ছতার সাথে কার্যকর করতে হবে। এটা দৃশ্যমান হলেও লক্ষমাত্রার তুলনায় কম হওয়ায় আরও গতি বাড়াতে হবে। প্রণোদনার ৫৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। সরকারের ডাটাবেজ না থাকায় করোনায় সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নিতে পারেনি।’

গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘২০ হাজারের মধ্যে আট হাজার কোটি টাকা সিএসএমই ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। শর্তের কারণে এটা কম। তাই ক্রেডিট স্কিমের আওতায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ক্যাপিটাল ফান্ডের ৯০ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে।

 কৃষিঋণ টার্গেট গ্রুপের কাছে ৫১ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে। একেবারে সুবিধাহীনদের জন্য তিন হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৯৬৭ কোটি টাকা ৩২ শতাংশ। মাইক্রোফাইন্যান্স ইনস্টিটিউটের (এনজিও) মাধ্যমে এই তহবিলের ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।

কিন্তু ২০ শতাংশেরও বেশি সুদ আদায় করায় আগ্রহ কম বলে জানান তিনি। সব প্যাকেজেই  ঋণ বিতরণ কম হয়েছে। ডিসেম্বরে পুরোটাই সম্ভব না হলেও ৯০ শতাংশ বিতরণ করা সম্ভব হবে। সেভাবে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশা দেয়া হয়েছে।’

বিসিক চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘বিভিন্ন শর্তের কারণে প্রণোদনার সুযোগ পাচ্ছেন না ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। অনেকের ব্যাংক হিসাব নেই। গ্যারেন্টি দেয়ার মতোও সুযোগ নেই।’ তাই তাদের জন্য আলাদা দুই হাজার কোটি টাকার তহবিল দেয়ার দাবি জানান তিনি।     
    
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘আর্থ-সামাজিক দিক বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনার ধাক্কা মোকাবিলায় প্রণোদনা প্যাকেজের উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা সবাই লাফিয়ে পড়েছিলাম। এ জন্য আমরা অতি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়েছি।

ফল ভালো পেয়েছি। ধাক্কা দেয়ার জন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রণোদনায় ঢিলেমি কেন? আমরা অর্থ রাখলেও তারা পাবে না, তা হয় না। ব্যাংকগুলো আইন মানতে বাধ্য। তারপরও কেন ঋণ দিচ্ছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ধরতে পারে না।’ ধীরগতি প্যাকেজের।

এসময় গভর্নরকে উদ্দেশ্য করে আরও বলেন, ‘রেগুলেশনের মতো ভয়ঙ্কর শব্দ বাদ দেন। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিতে জোর দিতে বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, মন্ত্রী হিসেবে নয়, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এসব হচ্ছে আমার বক্তব্য।’    

আমারসংবাদ/এআই