Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

শীতকালই ইবাতদের বসন্তকাল

মুফতী মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

ডিসেম্বর ৪, ২০২০, ১০:১০ এএম


শীতকালই ইবাতদের বসন্তকাল

শীতকালে পৃথিবীতে আল্লাহর বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়। শীতকালে আল্লাহ তায়ালার অপার কৃপায় জমিনে জন্মে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি। স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায় টাটকা শাকসবজি। 

মানবদেহের জন্য উপকারী এ সকল সবজির ব্যবস্থা কে করেন? উত্তর একটিই- আল্লাহ। তিনি বলছেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমি তো অঝর ধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করেছি। 

এরপর মাটিকে বিদীর্ণ করেছি। আর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্যাদি, আঙুর, শাকসবজি, খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট বাগান, ফলফলাদি ও ঘাস। এসব তোমাদের ও তোমাদের পালিত পশুকুলের জীবনধারণের জন্য, (সুরা আবাসা ২৪-৩২)। কাজেই শীতকালে মুসলমানদের প্রধান করণীয় হলো, মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা।

শীতকালে এতসব নিয়ামত দিয়ে আমাদের চারপাশকে যে মহান রব ভরে তোলেন প্রাণ ভরে তাঁর শুকরিয়া আদায়ই আমাদের প্রথম কাজ। শীতকালে দিন থাকে খুবই ছোট এবং ঠান্ডু। ফলে দীর্ঘ সময় না খেয়ে যেমন থাকতে হয় না, তেমনি তৃষ্ণার্ত হওয়ার ভয়ও কম। এজন্যই রসুল (স.) বলেছেন, ‘শীতল (সহজ) গনিমত হলো শীতকালে রোজা রাখা, (তিরমিজি ৭২৭ )।

শীতকাল মুমিনের জন্য অনন্য আশীর্বাদও বটে। অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে এ মৌসুমে অনেক বেশি ইবাদত করা যায়। তাই তো রসুল (স.) শীতকে মুমিনের বসন্তকাল বলে উল্লেখ করেছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (স.)বলেছেন, ‘শীতকাল হচ্ছে মুমিনের বসন্তকাল, (আহমাদ ১১২৯১)। শীতকালে পরিপূর্ণভাবে অজু করা অনেক সওয়াবের কাজ। 

এমনকি যদি কেউ গরম পানি দিয়ে অজু করে সেও সেই পুণ্য পাবে। ‘রসুল (স.) বলেছেন, আমি কি তোমাদের এমন কিছু শিখিয়ে দেব না যার কারণে আল্লাহ তায়ালা পাপ মোচন করবেন এবং জান্নাতে তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন? সাহাবিরা বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহর রসুল! 

তিনি বললেন, মন না চাইলেও ভালোভাবে অজু করা, অধিক পদক্ষেপে মসজিদে যাওয়া এবং এক নামাজের পর আরেক নামাজের জন্য অপেক্ষা করা, (মুসলিম ৩৬৯)। শীতকালে দিন থাকে খুবই ছোট। তাই বেশি বেশি নফল রোজা রাখারও এটি সুবর্ণ সময়। 

মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘বিশুদ্ধ নিয়তে যে ব্যক্তি এক দিন রোজা রাখল, মহান আল্লাহ প্রতিদানস্বরূপ জাহান্নাম এবং ওই ব্যক্তির মাঝখানে ৭০ বছরের দূরত্ব তৈরি করে দেবেন, (বুখারি, ২৮৪০)। কাজা রোজা রমজানের পরই আদায় করা উচিত। তবু যদি কোনো কারণে কারও কাজা রোজা থেকে যায় তবে এটিই হলো কাজা রোজাগুলো আদায় করে নেওয়ার উত্তম সময়। শীতকালে রাত হয় দীর্ঘ। 

কেউ যদি এশার সালাতের পর রাত ৯টায়ও ঘুমায় আর ভোর ৪টা পর্যন্ত টানা ঘুমায় তবু পুরো সাত ঘণ্টা ঘুমানো হবে। আর ভোর ৪টার পরও শীতকালে প্রায় দুই ঘণ্টা রাত থাকে। একজন মুমিন চাইলে সে দুই ঘণ্টা আল্লাহর নৈকট্য লাভে তাহাজ্জুদে কাটাতে পারে। তাই তো হাদিসে এসেছে, ‘শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মুমিন নফল নামাজ পড়তে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখতে পারে, (বায়হাকি)। 

অন্য হাদিসে এসেছে, শীতকাল হচ্ছে মুমিনের জন্য ইবাদতের বসন্তকাল। 

হজরত আমের ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘শীতল গনিমত হচ্ছে শীতকালে রোজা রাখা, (তিরমিজি :৭৯৫)। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় খাত্তাবি (রহ.) বলেন, ‘শীতল গনিমত মানে সহজলভ্য গনিমত। যেহেতু শীতের রোজায় রোজাদার গরমের তৃষ্ণা অনুভব করে না।’ 

এ প্রসঙ্গে ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জন্য শীতকালের চেয়ে প্রিয় কোনো সময় আছে কি না আমার জানা নেই। কারণ শীতের দিনগুলো ছোট থাকে আর রাতগুলো বড় হয়। তাই দিনে রোজা রাখা আর রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে থাকা সহজ হয়।’ সুতরাং বলা যায়, শীতকাল প্রভুপ্রেমিকদের জন্য এক অনন্য নিয়ামত। 

হজরত মু‘আজ ইবনে জাবালের (রা.) মৃত্যুর সময় তাঁকে তাঁর কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি না; বরং (রোজার কারণে) গ্রীষ্মের দুপুরের তৃষ্ণা, শীতের রাতের নফল নামাজ এবং ইলমের আসরগুলোতে হাজির হয়ে আলেমদের সোহবত হারানোর জন্য আমি কাঁদছি।’ শীতের রাতে গ্রামে গ্রামে আয়োজন করা হচ্ছে ওয়াজ মাহফিলের। 

এতে মুসলমানরা তাদের ঈমান-আকিদা ও আমলের সংশোধন করার পাশাপাশি পরকালের পাথেয় সংগ্রহের সহজ পন্থাও অবলম্বন করতে পারছে। লক্ষ রাখতে হবে, মাহফিলগুলো যেন হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও হেদায়েতের মাইলফলক হয়। 

শীতকালে অসহায়, শীতার্ত এবং দরিদ্রদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। এই যে আমাদের চারপাশে অসংখ্য মানুষ আছে, যারা ঠিকমতো দুই বেলা খেতে পায় না, হাড় কাঁপানো শীতেও যাদের একটি গরম কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই, আমরা কিন্তু ইচ্ছা করলেই এই অসহায় মানুষদের কষ্ট লাঘব করতে পারি। আমাদের অনেকেরই তো তিন-চারটি করে শীতের পোশাক রয়েছে। 

আমরা যদি সেখান থেকে একটি পোশাক তাদের দান করি, তাহলে তারা যতটা না খুশি হবে, দয়াময় আল্লাহ তাআলা তার চেয়ে বহু গুণ খুশি হবেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে মানবসেবাই পরম ধর্ম। 

আর এ কথাই ইসলামের প্রাণপুরুষ মুহাম্মদ (সা.) এই বিশ্বলোকে ছড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না, (মুসলিম, ২৩১৯)। তাই আসুন, শীতের এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাই। 

শীতের এই দীর্ঘ রজনীকে ঘুমের রাজ্যেই বিলীন না করে গভীর রজনীতে প্রকৃতি যখন বিভোর থাকবে ঘুমের অরণ্যে, যখন ডেকে উঠবে না কোনো নিশাচর, নড়বে না বৃক্ষপল্লব, তখন জেগে ওঠি প্রভুর সান্নিধ্যে। এই অস্থায়ী সুখকে তুচ্ছজ্ঞান করে পরকালীন চিরস্থায়ী সুখের প্রত্যাশায় আল্লাহর অদৃশ্য পায়ের সামনে দাঁড়াই অবনত মস্তকে।

লেখক : প্রভাষক (আরবী), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী। 

আমারসংবাদ/এআই