Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ বিশ্ব

হাসান জাবির

ডিসেম্বর ২২, ২০২০, ০৭:৫০ পিএম


পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ বিশ্ব

স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর যুগে বিশ্বব্যবস্থা যখন একটি মৌলিক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই বিশ্বব্যাপী মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যুদ্ধের আশঙ্কা। শুধু কি যুদ্ধের আশঙ্কা? রীতিমতো পরমাণু অস্ত্রের ঝনঝনানিতে এই মুহূর্তে শঙ্কিত পুরো বিশ্ব।

এই পরমাণু যুদ্ধভীতির প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশসমূহের লালিত ধ্বংসাত্মক নীতি। বিশেষত ইরান, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া, ভেনিজুয়েলা, কিউবা, চীন ও রাশিয়াসংক্রান্ত পশ্চিমাদের একপেশে ও বিদ্বেষমূলক নীতির চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া হিসেবে পরমাণুযুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে।

অবশ্য আমেরিকা ও তার মিত্রদের একপেশে নীতির বিপরীতে উপরোক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের কারণেই ত্বরান্বিত হয়েছে বিশ্বব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন; যে প্রক্রিয়ায় স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর যুগে প্রথমবারের মতো একপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থায় মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে মার্কিন কর্তৃত্ব।

এই আলোকে পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থায় নিজ আধিপত্য পুনরুজ্জীবিত করতে মরিয়া ওয়াশিংটন। অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ উত্তরণে আমেরিকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় বিদ্যমান বৈশ্বিক উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার নানা ইঙ্গিত মিলছে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, সামপ্রতিক বছরগুলোতে আমেরিকা নিরস্ত্রীকরণ, পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ এবং এতৎসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে একতরফা নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়েছে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার-সংক্রান্ত আইনি বাধ্যবাধকতা। আইনি শৈথিল্যের এই বাস্তবতায় আমেরিকাও নিজেকে বাঁধনমুক্ত করেছে এমন ধারণা অমূলক নয়।

আর এ কারণেই ভয়টি হচ্ছে বেশি। মূলত মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী ইরানকে ঘিরেই পরমাণু আক্রমণ আশঙ্কার বিভিন্ন ইঙ্গিত আমরা লক্ষ করছি। এখন পর্যন্ত ব্যাপারটি ইরানকে ভয় দেখানোর পর্যায়ে থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে এই মার্কিন নীতি পরিবর্তনের বিভিন্ন আভাস এখনই পাওয়া যাচ্ছে।

এছাড়া কোরিয়ান উপত্যকা, কৃষ্ণসাগর ও বাল্টিক সাগরভুক্ত এলাকাসহ বৃহত্তর ইউরোপে পরমাণু অস্ত্রের ঝনঝনানি সহসাই শোনা যাচ্ছে। প্রথমত আমেরিকা, এ ছাড়া রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রগুলোই এই মুহূর্তে সমগ্র বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক হুমকি।

এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে ঘিরে আমেরিকার সামরিক প্রস্তুতি ক্রমশ জোরদার হওয়ার স্পষ্ট দৃশ্য আমরা লক্ষ করছি। বেশ কয়েক বছর ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে আমেরিকা কর্তৃক অপ্রচলিত যুদ্ধ সরঞ্জাম মোতায়েন এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য প্রস্তুতি অজানা আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখ করার মতো একটি ব্যাপার হচ্ছে— পরমাণু অস্ত্রবাহী মার্কিন বিমান বি-৫২।

গত এক বছরের মধ্যে বিশাল আকৃতির বি-৫২ বিমানের কয়েকটি বহর দফায় দফায় ওড়াউড়ি করেছে পারস্য উপসাগরের আকাশে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে অন্তত দুটি বি-৫২ বিমান পারস্য উপসাগরের আকাশে বিপজ্জনকভাবে ওড়াউড়ি করায় ইরান বিষয়ে মার্কিন মনোভাবের অস্বচ্ছতা সবার জন্যই চিন্তার কারণ। এ ধরনের ইঙ্গিতবহ ঘটনা হঠাৎ যেনো বৈশ্বিক বিপর্যয়ের কারণ না হয়ে ওঠে, সেটি ভাবতে হবে এখনই।

উল্লেখ্য, সামপ্রতিক সময়ে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার মতপ্রার্থক্য। কিন্তু ইউরোপের ধোঁয়াশাচ্ছন্ন অবস্থানসহ আমেরিকার একগুঁয়েমির কারণে ইরান পরমাণু চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।

অন্যদিকে নাতাঞ্জ পরমাণু প্রকল্পের দুর্ঘটনা, দেশটির শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদের হত্যাকাণ্ডসহ এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে সামপ্রতিককালে বিবাদে জড়িয়েছে ইরান।

উপরোল্লিখিত ওই দুই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইরান আইএইএর সঙ্গে নিজেদের সহযোগিতা সীমিত করতে বেশ কিছু পাল্টা পদক্ষেপ নেয়ায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করছে। ফলে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ঘিরে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা মধ্যপ্রাচ্যের সংকটকে সহসাই ঠেলে দিচ্ছে অন্যদিকে।

এই আবহে দ্রুতই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। তাই ইরান বিষয়ে আমেরিকার নীতি পর্যালোচনা করলে যেসব নেতিবাচক চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার মধ্যে প্রথমেই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতা।

অন্যদিকে আপাতত পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও কোরিয়ান উপত্যকা ঘিরেও আছে অপ্রচলিত যুদ্ধের আশঙ্কা। এখানেও আমেরিকা-উত্তর কোরিয়া দ্বিপক্ষীয় বিরোধ তুঙ্গে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে যেকোনো মুহূর্তেই।

অন্যদিকে পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনার কেন্দ্রে আছে পরমাণু অস্ত্রের ঝুঁকি। এই ঝুঁকি যেকোনো সময় গুরুতর দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে। পক্ষান্তরে ইউরোপের সামরিক নিরাপত্তার প্রশ্নে দীর্ঘ সময় থেকেই মুখোমুখি অবস্থানে আছে রাশিয়া ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো।

এ দুই পক্ষের যাবতীয় সামরিক প্রস্তুতির উল্লেখযোগ্য অংশই হচ্ছে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার-সংক্রান্ত। উন্নত অস্ত্র, নিখুত আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ প্রতিহত করার বিষয়াদি দুই পক্ষের মধ্যে বরাবর অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। তাই পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে চলমান এসব উত্তেজনার কারণে যেকোনো মুহূর্তে পরমাণু আক্রমণের মারাত্মক ঝুঁকিতেই আছে বিশ্ব।

এখানে উল্লেখ করতে হয়, ১৯৬৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় পরমাণু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ-সংক্রান্ত নিউক্লিয়ার টেস্ট ব্যান ট্রিট্রি, যা সংক্ষেপে এনটিবিটি নামে পরিচিত। এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ঠাণ্ডা লড়াইয়ের উত্তেজনা প্রশমনের পাশাপাশি দুই পক্ষের বর্ধনশীল পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে এনেছিল।

কিন্তু আশির দশকের শুরুতেই রোনাল্ড রিগ্যান আমেরিকার ক্ষমতায় এলে এই স্থিতাবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এ ক্ষেত্রে ১৯৮৩ সালে রিগ্যান কর্তৃক তারকাযুদ্ধ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পোশাকি নামের বা তারকাযুদ্ধ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করলে দুই পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা আবার বহুলভাবে বেড়ে যায়। এতে করে স্নায়ুযুদ্ধ সমীকরণে আমেরিকার জন্য সামরিক অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হয়।

এই সূত্র ধরে বিশ্বব্যাপী আমেরিকার রাজনৈতিক প্রভাবের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। এরকম অবস্থার মধ্যে ১৯৮৭ সালে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে পরমাণু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ-সংক্রান্ত আরো একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কা প্রায় স্থায়ীভাবে হ্রাস পেয়েছিল। বিশেষত স্নায়ুযুদ্ধে পুঁজিবাদী স্বার্থ সুরক্ষার অনুকূলে ভূমিকা রাখা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অঞ্চল ইউরোপে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা একেবারে সীমিত করেছিল আইএনএফ চুক্তিটি।

প্রায় দুই যুগ ধরে আইএনএফ চুক্তির আওতায় রাশিয়া ও আমেরিকা যে অস্ত্র সংবরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলো, তার আনুষ্ঠানিক অবসান হয়েছে বছর দুয়েক আগে। এক ধরনের খামখেয়ালির বশেই আমেরিকা আইএনএফ চুক্তি থেকে একতরফাভাবে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে রাশিয়াও অনুরূপ ভূমিকা গ্রহণ করে। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসান হয় আইএনএফ চুক্তির।

আর চুক্তির অবসান হওয়ায় ইতোমধ্যে রুশ-মার্কিন পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিস্তার ঘটেছে। যে প্রক্রিয়ায় ইউরোপে পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি দ্রুতই স্নায়ুযুদ্ধ যুগের অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। অন্যদিকে এই ক্ষেত্র তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে ইউক্রেন সংকট।

মূলত ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে কিয়েভে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ ইউরোপের নিরাপত্তার প্রশ্নে নতুন এক প্রেক্ষাপটের অবতারণা করেছে। ইউক্রেন সংকটের জের ধরেই রাশিয়া ও ন্যাটো ইউরোপ বরাবর নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তির সমাবেশ ঘটিয়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত সেখানে অব্যাহতভাবে চলছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের বিপজ্জনক মহড়া।

এসবের মধ্যে সর্বাগ্রে আছে বিভিন্ন ধরনের পরমাণু অস্ত্র। এর ফলে কৃষ্ণসাগর ও বাল্টিক সাগরীয় এলাকা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি মাত্রায় পরমাণু অস্ত্রের ঝুঁকি ও পাল্টা ঝুঁকিতে আছে। তবে সব ছাপিয়ে যে বিষয়টি বেশি চিন্তার কারণ তা হচ্ছে ইরান।

এই মুহূর্তে ইসরাইলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্থাপনকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে চলছে এক ধরনের রাজনৈতিক রূপান্তর। এই রূপান্তর প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় চাপে পড়েছে ইরান।

অন্যদিকে সিরীয় সংকট সমাধান হওয়ার পর এই প্রথম কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে চলে গেছে আমেরিকা। তাই ভয় হচ্ছে বেশি। যদি খামখেয়ালির বশে, জেদে আবার হিরোশিমা-নাগাশাকি কাণ্ডের সূত্রপাত ঘটায় আমেরিকা কিংবা উল্লিখিত পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো?

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

আমারসংবাদ/এআই