Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য শ্রমিক নেতা বীরপ্রতীক সুফিয়ানের স্মৃতি অমলিন

বেগম মন্নুজান সুফিয়ান

ডিসেম্বর ২৮, ২০২০, ০৭:২০ এএম


বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য শ্রমিক নেতা বীরপ্রতীক সুফিয়ানের স্মৃতি অমলিন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আদর্শের অকুতোভয় সৈনিক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শ্রমিক নেতা অধ্যাপক আবু সুফিয়ানকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন বঙ্গবন্ধু তাকে ডেকে বললেন, তোকে জার্মানির রাষ্টদূতের দায়িত্ব দিতে চাই, তখন অধ্যাপক সুফিয়ান সবিনয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু আমাকে রাষ্টদূত করবেন কিন্তু আমার ৪০ হাজার শ্রমিক তো আর রাষ্টদূত হতে পারবে না। 

আমার ৪০ হাজার শ্রমিককে রেখে আমি কোথাও যেতে চাই না। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের আত্মার সাথে ছিলো তার নিবিড় সম্পর্ক। শ্রমিকদের কতটা ভালোবাসলে, শ্রমিকদের প্রতি কতটা হূদ্যতা থাকলে জাতির পিতার কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দেয়া যায় তার জ্বলন্ত উদাহরণ শ্রমিক নেতা আবু সুফিয়ান। 

এর কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়সহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য অধ্যাপক আবু  সুফিয়ানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে কয়েকজন শ্রমিক নেতাকে ৭২ সালে জার্মানিতে এক সম্মেলনে পাঠিয়েছিলেন। 

দেশে ফেরার পর ১২ দিনের মাথায় ২৮ ডিসেম্বর আজকের এই দিনে খুলনা-যশোর রোডের মহসিন মোড়স্থ ইসলাম ম্যানশনে কেন্দ্রীয় শ্রমিক লীগের আঞ্চলিক অফিসে ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের সাথে মিটিং শেষে বাসায় ফেরার সময় রাত দশটার দিকে রাস্তার ওপর দুর্বৃত্তদের ব্রাশ ফায়ারে মাত্র ২৯ বছর বয়সে শহীদ হন। মাত্র ২৯ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে শ্রমিক সমাজের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা শহীদ অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের (বীরপ্রতীক) আজ ৪৮তম শাহাদতবার্ষিকী। তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

তার নামের সাথে মিশে আছে দেশপ্রেমের দীপ্তমান আভা। শ্রমজীবী মানুষের প্রেরণার বাতিঘর, বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক। শিক্ষানুরাগী ত্যাগী এই মুক্তিযোদ্ধা জীবনের স্বল্পতম সময়ে মহসিন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে ভাইস-প্রিন্সিপাল হিসেবে শিক্ষকতা করেন। 

শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের পথিকৃত জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারকারী নেতাকে জাতির পিতা ’৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য জার্মানি থেকে ফেরার পর থেকেই উৎসাহ দিয়েছিলেন। 

একজন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের এদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার অসীম স্বপ্ন ছিলো। সবার সব স্বপ্ন সবসময় তো আর পূরণ হয় না। বিপথগামী কিছু মানুষ সমাজে থাকে যারা সমাজের মানুষের মঙ্গল চায় না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে আমার ব্যক্তিজীবনের চরমতম বেদনাবিধুর দিনে বঙ্গবন্ধুকেও খুব বেশি মনে পড়ছে। আবু সুফিয়ান দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত এই খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে তৎকালীন খুলনার পুলিশ সুপার বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন আহমদকে ফোন করে আবু সুফিয়ানের শেষ খবর নেন। 

বলেন, সুফিয়ানের দেহে যদি এতটুকুও প্রাণ থাকে তাহলে তুমি সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করো। বঙ্গবন্ধু এই দুঃসংবাদে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার শেষ দেখা ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্ট। সেদিন অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের স্মৃতি স্মরণ করে সুফিয়ানের সহধর্মিণী হিসেবে আমার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন।

সেদিন বঙ্গবন্ধু খুলনায় অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণে আমাদের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবরূপ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার মাত্র তিন দিনের মাথায় ইতিহাসের নৃসংশতম হত্যাকাণ্ডে জাতির পিতা সপরিবারে শাহাদতবরণ করলে আমাদের সে আকাঙ্ক্ষা অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যায়। অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের সাথে বঙ্গবন্ধুর স্নেহমাখা মধুর একটা সম্পর্ক ছিলো। 

কোঁকড়ানো লম্বা চুলের কারণে বঙ্গবন্ধু তার আদর্শের অকুতোভয় এই সৈনিককে আদর করে মোস্তান বলে ডাকতেন। মুজিববর্ষে অধ্যাপক সুফিয়ানের শাহাদতবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাদের অনেক স্মৃতি আজকে মনে পড়ছে। 

সম্ভবত ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মেলনের দিন সন্ধ্যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আমাকে এবং অধ্যাপক আবু সুফিয়ানকে দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি তোদের দেখে খুশি। কারণ তোরা এক পরিবারে দুজনই নেতা। অধ্যাপক সুফিয়ান প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা আর আমি তখন খুলনা বয়রা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি। অধ্যাপক সুফিয়ানের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু যে তিন বছর বেঁচে ছিলেন সবসময় আমাদের পরিবারের খোঁজ রেখেছেন। 

পিতার দেখানো পথ অনুসরণ করে তার সুযোগ্য দুই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা একান্ত আপনজনের মতো আমাকে এবং আমার পরিবারকে আগলে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাছে আমি চির ঋণী।

অধ্যাপক আবু সুফিয়ান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার আড্ডা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। অতি ছোট্ট জীবনে আবু সুফিয়ান দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন।

তিনি শিক্ষাজীবনে বিএল কলেজ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৬৬-৬৭ সালে শাহ্ মাখদুম হলের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। পরবর্তীতে শ্রমিক অধ্যুষিত খুলনা অঞ্চলের শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় শ্রমিক রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য সুফিয়ান বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি পলতা ইয়ুথ ক্যাম্পের ‘ক্যাম্প ইনচার্জ’ ছিলেন। যুদ্ধের সময় আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে যেসব বাঙালি ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন তাদের কাছে পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের এদেশি দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামসদের অত্যাচার, নির্যাতনের কথা শুনে কথিকা তৈরি করে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে সে কথিকা পাঠ করেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ত্যাগী এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সরকার বীরপ্রতীক উপাধি প্রদান করে। 

তিনি কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। এই মুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক জীবনে বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের খুলনা জেলা শ্রম সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার যোগ্য নেতৃত্বে খালিশপুর, দৌলতপুর, আটরা শিল্প এলাকায় ন্যায্য দাবি আদায়ে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। 

বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পথচলা শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের হূদয়ে স্থান দখলকারী ৪২টি ট্রেড ইউনিয়নের কোনোটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবার কোনোটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবু সুফিয়ানকে ৪৮ বছর পরও আজকের এই দিনে সারা দেশের শ্রমজীবী মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তাকে স্মরণ করে এদিন খুলনাসহ সারা দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো আলোচনা, শোকর্যালি, দোয়া মাহফিল এবং কাঙালি ভোজের  আয়োজন করে।

দেশপ্রেমিক আবু সুফিয়ানের সহধর্মিণী হিসেবে আজ ৪৮টি বছর আমি তার দেখানো পথে তারই স্বপ্নে জ্বলন্ত প্রদ্বীপ বহন করে চলেছি। স্বপ্নচারী কর্মঠ ত্যাগী মানুষটির অবদানকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তার আদর্শ বুকে ধারণ করে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি বছরের পর বছর। মাত্র ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে ২১ বছর বয়সে আমি মহান এই মানুষটিকে হারিয়ে চারদিকে দুচোখে অন্ধকার দেখি।

জীবন তো আর থেমে থাকার নয়, অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে মাত্র দুবছর বয়সি একমাত্র মেয়েকে সাথে নিয়ে গভীর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে আমি জাতির পিতার আদর্শ হূদয়ে ধারণ করে শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়াই। 

এ দেশের লাখো কোটি শ্রমজীবী-মেহনতি অসহায় মানুষের ভালোবাসা এবং আমাদের সকলের আস্থার স্থল বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদ নিয়ে আজ আমি জনপ্রতিনিধি হয়ে জনসেবার সুযোগ পেয়েছি। 

বলতে দ্বিধা নেই— আমার আজকের অবস্থান, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি আর শ্রমিক নেত্রী মন্নুজান সুফিয়ান হয়ে ওঠার মূল প্রেরণা অধ্যাপক আবু সুফিয়ান। শ্রমিক নেতা অধ্যাপক সুফিয়ান তার কাজের মাধ্যমে লাখো শ্রমিকের হূদয়ে অনাদিকাল বেঁচে থাকবেন। তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন স্বাধীনতার চেতনায় ভাস্বর কোটি মানুষের অন্তরে।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক শ্রমিক নেতা অধ্যাপক সুফিয়ান বেঁচে থাকবেন তার কর্মের মাঝে, তার আদর্শের মাঝে। গণমানুষের এই নেতার প্রতি আবারো জানাই অজস্র ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

লেখক : প্রতিমন্ত্রী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

আমারসংবাদ/এআই