Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

‘কোভিড মোকাবিলায় ব্লুমবার্গ স্বীকৃতি; স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা’

মো. মাইদুল ইসলাম প্রধান

ডিসেম্বর ৩০, ২০২০, ০৬:৩০ পিএম


‘কোভিড মোকাবিলায় ব্লুমবার্গ স্বীকৃতি; স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা’

এই মুহূর্তে বিশ্বে করোনায় মৃত্যু ১৭ লাখ ৮১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্ত আট কোটি ১৬ লাখের বেশি। কোভিড মোকাবিলায় ব্যর্থতার জেরেই আমেরিকায় এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরে গেছেন বলেই অনেকের ধারণা।

ইউরোপের অনেক দেশেই দ্বিতীয়বারের মতো লকডাউন চলছে। দিন যতই যাচ্ছে, আমেরিকা-ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক শক্তিধর দেশের অর্থনীতির করুণ চিত্র ততই ফুটে উঠছে। পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান, ভারতের অবস্থাও খারাপ। এই কোভিডে ভারতে মোট মৃত্যু এক লাখ ৪৮ হাজার, আক্রান্ত এক কোটি দুই লাখ ২৪ হাজারেরও বেশি। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে মোট মৃত্যু সাত হাজার ৪০০ জন, আক্রান্ত পাঁচ লাখ ১০ হাজারের মতো।

সম্প্রতি আমেরিকার ডাটাভিত্তিক জনপ্রিয় মিডিয়া ব্লুমবার্গ কর্তৃক করোনা মোকাবিলায় সক্ষমতার ভিত্তিতে বিশ্বের দেশগুলোর ওপর একটি জরিপ চালিয়েছে। জরিপে পাকিস্তান ২৯তম, যুক্তরাজ্য ৩০তম এবং খোদ আমেরিকার অবস্থান ৩৭তম।

যেখানে ভারতের অবস্থান ৩৯তম। এছাড়াও বাংলাদেশের নিচে রয়েছে জার্মানি, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড, মিসর, সু্ইডেন, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া থেকে অন্তত প্রায় ১৮৫টির মতো দেশ। আর বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে ২০তম অবস্থানে উঠে এসেছে।

এর থেকেও বড় সংবাদ হচ্ছে এই জরিপে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশের উপরে অবস্থান করছে। দেশের মানুষ তো বটেই খোদ বিশ্ববাসীই অবাক হয়েছে কোভিড মোকাবিলায় বাংলাদেশের এত বড় সাফল্য দেখে।

এমন নয় যে, ব্লুমবার্গ কেবল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থান দেখেই এই র্যাংকিং করেছে, বরং প্রতিষ্ঠানটি জরিপ চালিয়েছে অন্তত কোভিডের ১০টি মেট্রিকসের ওপর যেখানে ছিলো কোভিডে মৃত্যুহার, কোভিড পরীক্ষা সুবিধাদি, জনবল, স্বাস্থ্যসেবা দানের সক্ষমতা, চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি। এসব গুরুত্বপূর্ণ মেট্রিকসগুলো থেকে বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে ২০তম অবস্থান ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম হওয়াটা নিঃসন্দেহে অলৌকিক কোনো ঘটনায় হয়নি।

জনসংখ্যা, আয়তন বা আর্থিক সক্ষমতা কিংবা জনবল, কারিগরি সুযোগ-সুবিধা যেদিকেই বলি না কেন, বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর নিচে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫৪ লাখের মতো। সেই তুলনায় আমেরিকার ৩৩ কোটি যা বাংলাদেশের থেকে দ্বিগুণেরও কিছুটা কম। অথচ কোভিড আক্রান্তে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪০ গুণ বেশি।

ব্রাজিলের জনসংখ্যা ২১ কোটির মতো, যা বাংলাদেশের থেকে সামান্য বেশি অথচ করোনায় আক্রান্ত বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে ১৫ গুণ বেশি। ইউরোপের প্রায় সব দেশেরই বাংলাদেশের থেকে জনসংখ্যা কম অথচ আক্রান্তে ও মৃত্যুতে বাংলাদেশ থেকে বহুগুণ বেশি তাদের। যুক্তরাজ্যে জনসংখ্যা মাত্র ছয় কোটি অথচ কোভিডে আক্রান্ত ২৩ লাখ। জনসংখ্যায় যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের অর্ধেকেরও অনেক কম।

অথচ বাংলাদেশ থেকে করোনায় মৃত্যুতে ১০ গুণেরও বেশি। ফ্রান্সে জনসংখ্যা সাড়ে ছয় কোটি। কোভিডে আক্রান্ত সাড়ে ২৫ লাখ যা বাংলাদেশ থেকে ৫ গুণ বেশি, আর মৃত্যুতে ৯ গুণ বেশি। অথচ এই দেশগুলোর সক্ষমতা বা আর্থিক ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশ থেকে বহুগুণ বেশি।

 পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জনসংখ্যা ১৩৮ কোটি যা বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭ ভাগ বেশি। ভারতে করোনায় মোট আক্রান্ত এক কোটিরও বেশি, মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের। ভারতের সাথে আমাদের আবহাওয়াগত মিল থেকে শুরু করে সব দিকেই মিল রয়েছে অথচ ভারতে মৃত্যু বাংলাদেশের থেকে ২৯ গুণ বেশি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কোন জাদুশক্তিবলে বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তিধর ও পরাক্রমশালী দেশগুলোকে পেছনে ফেলে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো? কোভিডের এই বিপর্যয়ে বিশ্বের মেগা শক্তিধর দেশগুলো যেখানে অর্থনৈতিকভাবে জিরো থেকে মাইনাস প্রবৃদ্ধিতে চলে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ বৃদ্ধি রয়েছে। বৈদেশিক রেমিটেন্সে এই কোভিড মহামারির সময়ে অতি আশ্চর্যজনকভাবে সর্বোচ্চ এসেছে।

অবশ্যই এমনি এমনি বা কোন অদৃশ্যশক্তিবলে বাংলাদেশের এই অর্জনটি সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এই দেশে কোভিডের মতো এত বড় বিপর্যয় সামলানো মোটেও সহজ কাজ ছিলো না। অবশ্যই দেশের চিকিৎসা খাত, দেশের প্রশাসন ও দেশের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত সঠিক ও সময়োপযোগী ছিলো।

মার্চে দেশে করোনা ভাইরাস প্রথম সংক্রমিত হওয়ার আগে থেকেই স্বাস্থ্য খাত কোভিড মোকাবিলায় চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন প্রস্তুত করেছিল এবং একই সাথে বহুসংখ্যক চিকিৎসক ও নার্সকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার আগেই অর্থাৎ ১ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটিতে ত্রাণ ও দুর্যোগ, বিমান, পররাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবসহ অন্যান্য সিনিয়র সচিব, সচিবপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের রাখা হয়। এই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অতি দ্রুত দেশের সকল বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে বিভাগ, জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে কোভিড মোকাবিলায় অত্যন্ত কার্যকর বেশকিছু কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিগুলো বিদেশফেরত ও আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তিদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণসহ কোভিড সচেতনতায় প্রচারণায় ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে।

এভাবে দেশের সবচেয়ে খ্যাতনামা ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কোভিড পরামর্শক কমিটিসহ সময়ে সময়ে যখন যে কমিটি গঠন করা প্রয়োজন তা করা হয়েছে। এগুলো কোভিড মোকাবিলায় কাজে লেগেছে। দেশের চিকিৎসকদের জীবন বাজি রেখে চিকিৎসা দেয়া থেকে শুরু করে সময় মতো হাসপাতালে শয্যা প্রস্তুত রাখা, আইসিইউয়ের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত ১২৪টি মতো সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা, হাসপাতালগুলোকে আরও সেবামুখী করেছে।

কোভিডের উৎপত্তি নিয়ে নানামনে নানা প্রশ্ন রয়ে গেছে। মূলত এর উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে, মানুষ না অন্য কোনো প্রাণী থেকে সেটি আজও বিতর্কিত বিষয়। কোভিডের চিকিৎসা নিয়ে শুরুর দিকে কেবল বাংলাদেশই না, বিশ্বের বহু দেশই সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলো। চিকিৎসক, নার্সসহ সব মানুষই উৎকণ্ঠায় দিন কাটিয়েছে। খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড ট্রিটমেন্ট নিয়ে অন্তত আটবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে।

বাংলাদেশে সে সময় কেবল আইডিসিআরের একটি মাত্র কোভিড পরীক্ষা সেন্টার ছিলো। বর্তমানে দেশে ১১৮টি কোভিড পরীক্ষা কেন্দ্র, এর সাথে পর্যাপ্ত অ্যান্টিজেন টেস্টসহ নানারকম উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশ্বের বহু দেশই তাদের নিজ নিজ দেশের সাথে বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় কোভিড পরীক্ষা কেন্দ্র বৃদ্ধি করার কাজটি একেবারেই সহজ কাজ ছিলো না।

পরীক্ষার জন্য কীট সংগ্রহ করাটাও একই কারণে কঠিন ছিলো। মানুষ মানুষকে ভয় পেতে শুরু করেছিল। কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হতো সে সময়। ভয়ে মানুষজন কোভিডে আক্রান্ত হলেও গোপন করতো। তথ্য গোপন করায় দেশের অন্তত একশরও বেশি চিকিৎসক মারা গেছেন। এমন দুঃসময়ে দেশের স্বাস্থ্য খাতের হাল ধরলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পাশে নিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে থাকলেন তিনি।

প্রায় প্রতিদিনই স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে করণীয় ঠিক করে দিলেন। স্বাস্থ্য খাতের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করলেন। একদিকে করোনা মোকাবিলা করতে থাকলেন, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে দেশের শিল্প-কলকারখানা খুলে দিলেন। অনেকেই অনেক সমালোচনা করলেন। কারো কথায় কর্ণপাত না করে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে সোজা করে ধরে রাখলেন তিনি। দেশেই প্রস্তুত হতে থাকলো চিকিৎসক, নার্সদের জন্য পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই)।

এতই পিপিই দেশে প্রস্তুত হলো যে, সেগুলো দেশের চাহিদা পূরণ করে অধিক লাভে বিদেশেও রপ্তানি হতে থাকলো। হোটেল, মুদি দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে দেশের কর্মজীবী মানুষদের আর্থিক অনটনে পড়তে  দিলেন না। বিমান চলাচল চালু রেখে বিদেশে জনবল পাঠানো ও বৈদেশিক আয় কেবল ধরেই রাখলেন না, সর্বোচ্চ রেমিটেন্স পেলো দেশ। করোনাকালীন মহামারিতে অর্থনীতিতে যুক্ত হলো আরও ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি।

অনেকেই বলে থাকেন, আবহাওয়াগত সুবিধার কারণে বাংলাদেশ কোভিড মোকাবিলায় এতটা সফল হয়েছে। কিন্তু এই একই আবহাওয়া নিয়ে ভারত বর্তমানে বিশ্বে আক্রান্ত তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। অর্থনৈতিকভাবে ভারতের করুণ অবস্থা যাচ্ছে। করুণ অবস্থা যাচ্ছে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেরই।

ভ্যাকসিন সংগ্রহের দিক দিয়েও বাংলাদেশ অনেক দেশকেই চমকে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ গত ৫ নভেম্বরে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করায় ধরে নেয়া হচ্ছে জানুয়ারি-২০২১ অথবা ফেব্রুয়ারির শুরুতেই বাংলাদেশে তিন কোটি অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন চলে আসবে। এই কাজটিই মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো করতে পারেনি।

দেশের কোভিড নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে জোড়ালো ভূমিকা ছিলো হাসপাতাল চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, টেলিমেডিসিন সেবা, সঠিকভাবে প্রচারণা ও প্রশাসনিক দক্ষতা। আর অবশ্যই সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা। অন্য দেশগুলো কোভিডকে অবহেলা করেছে।

কোভিডকে ‘চায়না-ভাইরাস’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। বাংলাদেশ শুরু থেকেই দায়িত্ব নিয়ে কোভিড মোকাবিলা করেছে। দেশের স্বাস্থ্য খাতকে প্রস্তুত করে রেখেছে। দেশের স্বল্প পুঁজি নিয়ে সঠিক পন্থায় করণীয় ঠিক করে যেভাবে এই পৃথিবী কাঁপিয়ে দেয়া করোনা মোকাবিলা করে যাচ্ছে, এটি কেবল বিরলই নয়; এটি সত্যিই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট পাওয়া।

লেখক : সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়

আমারসংবাদ/এআই