Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

চার মামলার ভাগ্য নির্ধারণ রিভিউয়ে

জানুয়ারি ৫, ২০২১, ০৯:০০ পিএম


চার মামলার ভাগ্য নির্ধারণ রিভিউয়ে

উচ্চ আদালত। বিচারপ্রার্থীদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। নিম্ন আদালতে বিচারকাজ শেষ হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে। উচ্চ আদালতে এসেও আটকে আছে বছরের পর বছর। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ শেষ করে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে আছে আপিল রিভিউয়ে। রিভিউ নিষ্পত্তি হলে এসব মামলার ভাগ্য নির্ধারণ হবে। তবে রিভিউয়ের জট কমছে না। অপেক্ষারও শেষ হচ্ছে না।

দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এমন আলোচিত প্রায় দেড় ডজন মামলা ঝুলে রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব মামলা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রিভিউ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েও বিচারের সমাপ্তি ঘটছে না। কবে নাগাদ নিষ্পত্তি হবে সেটাও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে সম্প্রতি নতুন আলোচনায় এসেছে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাসহ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ এনে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্তের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানিয়েছেন ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক। তবে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান বিদ্যমান আছে কিনা তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। বিষয়টি নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন সাংবিধানিক বিতর্ক।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলছেন, এখন সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান নেই। আবার অপর পক্ষ বলছেন আছে। এ নিয়ে এক প্রকার বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে রিভিউয়ে ঝুলে আছে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা।

সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বাতিল : উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। তবে এ সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী রিট করেন। এরপর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট।

এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে আপিল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। এরপর রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। সেই আবেদন এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হওয়ার আগে উচ্চ আদালতের বিচারকসহ সাংবিধানিক বিভিন্ন পদের ব্যক্তিদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের এখতিয়ার ছিলো রাষ্ট্রপতির। তবে এই সংশোধনী উচ্চ আদালত বাতিল করায় এবং রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়ায় পুরো বিষয়টি ঘিরে রয়েছে অস্পষ্টতা।

এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মনে করেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন গ্রহণের সময়ে আপিল বিভাগ রায়টি স্থগিত না করে থাকলে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান এখনো বিদ্যমান। আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকও একই ধরনের মত দিয়েছেন।

ভ্রাম্যমাণ আদালত অবৈধ আপিল নিষ্পত্তিতে দফায় দফায় সময় বৃদ্ধি : এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ৯টি ধারাকে অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৭ সালের ১১ মে রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। রায়ে ২০০৯ সালে পাস হওয়া এ আইনকে সংবিধান পরিপন্থি ও এখতিয়ার বহির্ভূত হিসেবে ঘোষণা করে আদালত। তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দেয়ার এ বিধানকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা পৃথকীকরণের মতো দুটি মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করেছে বলে ওই রায়ে বলা হয়।

একইসঙ্গে হাইকোর্ট ওই রায়ে অভিমত দেয় যে, সরকারের নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা কোনো অবস্থাতেই বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ২ জুলাই পর্যন্ত ওই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এরপর আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যুক্তি দেখিয়ে দফায় দফায় এ স্থগিতাদেশ বাড়িয়ে নিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।

এ বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী হাসান এমএস আজিম বলেন, ‘সরকার বারবার আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ দেখিয়ে সময় বাড়িয়ে নিচ্ছে। এতে রায়ের কার্যকারিতা বন্ধ থাকছে না। আর এতে সাধারণ মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই মামলার আপিল শুনানি দ্রুত শুরু করা উচিত। অন্যথায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের এ আইনের প্রয়োগ বন্ধ রাখা উচিত।’ এ আইনের বড় ত্রুটি হলো যার বিরুদ্ধে মামলা অর্থাৎ যিনি আসামি তিনিই সাক্ষী। এটি হতে পারে না বলে মনে করেন রিটকারী এ আইনজীবী।

এটিএম আজহারের মৃত্যুদণ্ডের রিভিউ শুনানি : মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম গত ১৯ জুলাই আপিল বিভাগের দেয়া রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করেন। এর ফলে বিচারিক আদালতে দেয়া রায়ের ছয় বছর পরও বিচার সমাপ্তি হলো না। এখনো রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরও দুটি ধাপ রয়ে গেছে। এর একটি হলো রিভিউয়ের রায়। অপরটি হলো রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ। গত ১৯ জুলাই জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ডের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন ভার্চুয়াল আপিল বিভাগের নজরে আনেন (মেনশন করা) রাষ্ট্রপক্ষ।

তখন আদালত জানায়, এটিএম আজহারুল ইসলামের রিভিউ শুনানি ভার্চুয়াল কোর্টে হবে না। নিয়মিত আদালত চালু হলে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এই মামলার রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি হবে। যদিও বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সকল মামলার শুনানি ভার্চুয়ালি হচ্ছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রদান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আজহার নিজেকে নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়ে আপিল করেন। পরে আজহারুল ইসলামের করা আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। পরে গত ১৫ মার্চ এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। এর পরদিন ১৬ মার্চ তার মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে পাঠায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর রিভিউ আবেদন করেন আজহার।

এ বিষয়ে এটিএম আজহারুল ইসলামের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করেছি। পরে রাষ্ট্রপক্ষ এটি ভার্চুয়াল কোর্টে মেনশন (নজরে আনা) করে। তখন আদালত জানায়, এ মামলার রিভিউ শুনানি ভার্চুয়াল কোর্টে নয়, নিয়মিত কোর্টে হবে। অর্থাৎ নিয়মিত আদালত চালু হলে এ মামলার রিভিউ শুনানি হবে।’

জজদের পদমর্যাদার রিভিউ শুনানি পড়ে আছে তিন বছর : রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) চ্যালেঞ্জ করে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পক্ষ থেকে করা রিট মামলাটি ১৪ বছর ধরে ঝুলে আছে সর্বোচ্চ আদালতে। সরকারের কার্যপ্রণালী বিধি (রুলস অব বিজনেস) অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ২০০০ সালে সরকার এটি সংশোধন করে। সংশোধিত এ ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৬ সালে হাইকোর্টে রিট করেন বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব আতাউর রহমান।

২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জেলা জজদের পদমর্যাদা নির্বাহী বিভাগের সচিবদের পদমর্যাদার সমমান মর্যাদা দিয়ে রায় প্রদান করে হাইকোর্ট। রায়ে পূর্বের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বাতিল করে আট দফা নির্দেশনা দিয়ে এটি নতুনভাবে তৈরি করতে বলা হয়। এ রায় বাস্তবায়ন করলে প্রশাসনে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে এমন দাবি করে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। আপিল বিভাগ ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি এ বিষয়ে রায় দেন। পরে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপক্ষ রায়টি পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে। যা এখনো বিচারাধীন রয়েছে।

এ মামলাটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়ায় জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে জেলা জজদের মধ্যে পদমর্যাদা নিয়ে দূরত্ব পরিলক্ষিত হয়। এ জন্য রিভিউ আবেদনটি জরুরিভিত্তিতে নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিচারসংশ্লিষ্টরা। জেলা জজদের পদমর্যাদার সংক্রান্ত এ মামলার বিষয়ে কয়েক দফা চেষ্টা করেও বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদনের কথা জানিয়েছিলেন।তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এই রায়ের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) চেয়ে আবেদন করেছি। যা এখন শুনানির জন্য অপেক্ষায় আছে।’

আমারসংবাদ/জেআই