Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে!

লিটন আহমেদ, তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ)

জানুয়ারি ১১, ২০২১, ০৮:৪৫ পিএম


বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে!

দেখতে দেখতে বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় পেরিয়ে যাচ্ছে আরেকটি বছর। তারপরও চাঞ্চল্যকর মেধাবী কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রুপাকে গণধর্ষণ ও হত্যামামলায় বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে। গত তিনটি বছর বিচারের আশায় বুক বেঁধে থাকা রুপার বৃদ্ধ মা হাসনা হেনা মেয়ে হত্যার বিচার তার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবেন কি-না এমন আশা ছেড়েই দিয়েছেন বলে তিনি জানান।

অপরদিকে হত্যামামলার বাদি রুপার বড় ভাই হাফিজুর রহমান প্রামাণিক তার প্রিয় বোনের হত্যামামলার দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে রীতিমতো হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, বিচারের আশায় বিভিন্নজনের কাছে পরামর্শ নিয়েও কিছুই করতে পারছি না। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম রুপাকে হারিয়ে শোকাহত পরিবারটি নিম্ন আদালতে স্বল্প সময়ে বিচার পেয়ে আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে, রুপা হত্যার বিচার দ্রুত শেষ হবে। কিন্তু হাইকোর্টে গত দুই বছর ৯ মাস যাবৎ আপিল শুনানি শুরু না হওয়ায় চাঞ্চল্যকর রুপা গণধর্ষণ ও হত্যামামলা কবে শেষ হবে তা নিয়ে ওই পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজন রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়েছেন।

তাড়াশ নাগরিক আন্দোলনের নেতা বিশিষ্ট সাংবাদিক আব্দুর রাজ্জাক রাজু বলেন, চাঞ্চল্যকর রুপা হত্যামামলাটি বিচারিক আদালতে আপিল শুনানিতে আটকে আছে দীর্ঘ সময় ধরে। আবার হাইকোর্টে আপিল শুনানি শুরু হলেও মামলার আরও পর্যায়গুলো পেরোতে সময় লাগবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দীর্ঘ সময়ে মামলাটির স্থবির অবস্থা আমদেরকেই ভাবিয়ে তুলছে। আর রুপার পরিবারের সদস্যদের বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় হতাশা প্রকাশ করবে এটাই স্বাভাবিক।

জানা গেছে, গত দুই বছর ৯ মাস যাবৎ হাইকোর্টে ঝুলে আছে রুপা গণধর্ষণ ও হত্যামামলার আপিল শুনানি। আপিল শুনানি প্রসঙ্গে টাঙ্গাইলে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি নাসিমুল আক্তার নাসিম জানান, ‘নিম্ন আদালতে রায় ঘোষণার পর আসামিদের মৃত্যুদণ্ড হলে তার নথিপত্র দ্রুততম সময়ে মহামান্য হাইকোর্টে চলে যায়। পরে আপিল হলে তা কার্যতালিকায় আসলে পযায়ক্রমে আপিল শুনানি হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যকর রুপা গণধর্ষণ ও হত্যামামলায় আপিল শুনানি হয়তো এখনো মহামান্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় আসেনি। তাই শুনানিও শুরু হয়নি। বিষয়টি সম্পূর্ণ মহামান্য আদালতের এখতিয়ার।’

রুপা হত্যামামলার বাদি রুপার বড় ভাই হাফিজুর রহমান বলেন, গত তিন বছরেও আমার বোনের হত্যামামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। অথচ রুপা হত্যার পর বিভিন্ন স্তরের নেতারা মামলাটি দ্রুত বিচার আইনে শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বেঁচে থাকলে হয়তো মামলা-সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের সহযোগিতা করতেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তাকে এই প্রযোজনীয় মুহূর্তে অসহায় আমাদের পরিবার আর তাকে পাচ্ছি না।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা শেষে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার আসান বাড়ি গ্রামের মৃত. জেলহক প্রাং-এর মেয়ে মেধাবী তরুণী রুপাকে চলন্তবাসে গণধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করে পরিবহণ শ্রমিকরা। পরে চলন্ত বাসেই তাকে হত্যার পর টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলায় পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে রুপার মরদেহ ফেলে রেখে যায়। পরে খবর পেয়ে মধুপুর থানা পুলিশ ওই রাতেই অজ্ঞাত পরিচয় নারী হিসেবে তার মরদেহ উদ্ধার করে। পরদিন ময়নাতদন্ত শেষে রুপার মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় গোরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে মধুপুর থানায় গণধর্ষণ ও হত্যামামলা দায়ের করে। পরের দিন পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে রুপার ভাই হাফিজুর রহমান মধুপুর থানায় গিয়ে ছবির ভিত্তিতে ছোট বোন রুপার লাশ শনাক্ত করেন।

২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ময়মনসিংহ-বগুড়া সড়কের ছোঁয়া পরিবহণের হেলপার শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীর এবং চালক হাবিবুর ও সুপারভাইজার সফর আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা প্রত্যেকেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

মামলা-সংক্রান্ত বিষয়ে আরও জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক আবুল মনসুর মিয়া রুপা হত্যামামলার রায়ে চার আসামির ফাঁসি ও একজনের সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানার রায় ঘোষণা করেন। এদের মধ্যে ময়মনসিংহের ছোঁয়া পরিবহণের হেলপার শামীম (২৬), আকরাম (৩৫) ও জাহাঙ্গীর (১৯) এবং চালক হাবিবুরকে (৪৫) ফাঁসি ও সুপারভাইজার সফর আলীকে (৫৫) সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে আর্থিক জরিমানার আদেশ দেন।

এছাড়া ছোঁয়া পরিবহণের ওই বাসটি রুপার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদানেরও আদেশ প্রদান করা হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সাজাপ্রাপ্ত সকল আসামি খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন। তার পর  চাঞ্চল্যকর ওই মামলায় আপিল শুনানি আজও শুরু হয়নি বলে জানান মামলার বাদি রুপার বড়ভাই হাফিজুর রহমান প্রামাণিক। তিনি আরও জানিয়েছেন, নিম্ন আদালতে আমরা দ্রুততম সময়ে ১৭১ দিন পর টাঙ্গাইল অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ প্রথম আদালতে মামলার রায় ঘোষণায় সন্তুষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু উচ্চ আদালতে আসামিপক্ষের আপিলের পর মামলাটি দীর্ঘ সময়ে শুনানি না হওয়ায় অসহায় বোধ করছি।

আমারসংবাদ/জেআই