Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

শিক্ষার্থীদের মানসিক যন্ত্রণা

আবদুর রহিম

জানুয়ারি ১২, ২০২১, ০৮:০০ পিএম


শিক্ষার্থীদের মানসিক যন্ত্রণা

জেসমিন আক্তার শান্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। শুরু হচ্ছে ফাইনাল পরীক্ষা। এখনো ঠিক করতে পারেনি ঢাকায় এসে কোথায় থেকে পরীক্ষা দেবে। স্বল্প সময়ের নোটিসে কোথাও বাসা ভাড়া পাচ্ছেন না। ২-১ মাসের জন্য কেউ বা ভাড়াও দিচ্ছেন না। রয়েছে নিরাপত্তার শঙ্কা। পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণার পর থেকে মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে ওই শিক্ষার্থী। হল বন্ধ রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজ ও অন্যান্য কলেজগুলোতেও পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণার পর শিক্ষার্থীরা থাকার জায়গা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে।

গতকাল আবাসিক হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের প্রতীকী কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খুলে পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে গত ২৩ ডিসেম্বর থেকে ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ’ অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছে। আন্দোলন হচ্ছে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র সংগঠনগুলোও হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন হল খুলে দেয়ার জন্য। ছাত্রলের নেতারাও প্রশাসনের কাছে একই দাবি জানাচ্ছেন। আন্দোলন করছেন বাম সংগঠনের নেতারা। অভিভাবকরাও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য হল খুলে পরীক্ষা নেয়ার দাবি তুলেছেন।

তারা বলছেন, বাড়ি ভাড়া পাওয়ার ব্যবস্থা-আর্থিক সংস্থান কীভাবে হবে সে বিষয় না ভেবে, মেয়েরা কোথায়-কীভাবে থাকবে সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত না করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এই মুহূর্তে আবাসিক হল খোলা ‘সম্ভব নয়’। কষ্ট হলেও ঢাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাসা কিংবা মেসে থেকে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে হবে।

জানাগেছে, হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণায় শিক্ষার্থীরা কেউ সাড়া দিচ্ছে না। সমপ্রতি ‘স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে আবাসিক হল খোলা ছাড়া পরীক্ষা নেয়ার বিষয়টি যৌক্তিক কি না সে বিষয়ে জনমত জরিপ করা হয়। এতে ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী আবাসিক হল খোলা ছাড়া পরীক্ষা নেয়ার বিষয়টি ‘অযৌক্তিক’ বিবেচনা করে ভোট দেন।

অপরদিকে মাত্র ৮ ভাগ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক বলে ভোট দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দিয়ে রুটিন প্রকাশ করলেও এখনো পর্যন্ত মানবণ্টন কীভাবে হবে তা নিশ্চিত করতে পারেননি ঢাবি প্রশাসন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে প্রশাসনের কাছে হল খুলে পরীক্ষা নেয়ার আবেদন জানিয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ— প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল অনলাইনে ক্লাসের জন্য শিক্ষার্থীদের ডিভাইস দেয়া হবে, ইউজিসি বলেছে শিক্ষার্থীদের টাকা দেয়া হবে। এখন পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীও সেই সুযোগ পায়নি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কেউ ক্লাসেও অংশগ্রহণ করতে পারেনি।

সমপ্রতি হল খুলে দেয়ার দাবিতে ঢাবি উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী, নাজিম উদ্দিন, সংস্কৃতিবিষয়ক উপসম্পাদক তিলোত্তমা শিকদার, উপ-গ্রন্থ ও প্রকাশনা সম্পাদক ফরিদা পারভীন।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এ দাবির প্রতি ছাত্রদল, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও প্রগতিশীল ছাত্রজোট সবাই একমত হয়েছে। তারা বলছেন, অগ্রাধিকারভিত্তিতে পরীক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে হল খুলে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে করোনা ইউনিট স্থাপন এবং পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হবে।

এদিকে আবাসিক হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের প্রতীকী কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এ কর্মসূচি পালিত হয়।

সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল এবং প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানীর কুশপুত্তলিকা দাহ করেন সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা।

কর্মসূচি শেষে তিন দফা দাবি পেশ করে তা আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে মেনে নেয়ার দাবিও জানান তারা। দাবি আদায় না হলে আগামী ২৪ জানুয়ারি দুপুরে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়।

দাবিগুলো হলো— স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিত করা, করোনাকালীন বেতন-ফি মওকুফ করা ও টিএসসির বর্তমান অবকাঠামো না ভাঙা।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘আবাসিক হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক। কোনোভাবেই এটি ছাত্রবান্ধব সিদ্ধান্ত নয়। আমরা শুরু থেকে হল খুলে পরীক্ষা নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু দাবি পূরণে প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। আমাদের তিন দফা দাবি আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে না মেনে নিলে কঠোর কর্মসূচিতে যাবো।’ কর্মসূচিতে আরও উপস্থিত ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঢাবি সাধারণ সম্পাদক প্রগতি বর্মন তমা এবং ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি সভাপতি সাখাওয়াত ফাহাদ। সভাপতিত্ব করেন প্রগতিশীল ছাত্রজোট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক সোহেল আহাম্মেদ শুভ।

ঢাবির ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী আফসানা তাসনিম বলেন, পরীক্ষা নিতে হবে চাপমুক্ত রেখেই। যেহেতু সবকিছুই স্বাভাবিক, সেক্ষেত্রে হল খুলে পরীক্ষা নিলে শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে মানবিক ও সুবিবেচিত সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে করছি। এভাবে পরীক্ষা নিলে মানসিক চাপের মধ্যে অসুস্থ হয়ে যাবো। আমি থাকি সাতক্ষীরা। এখন পর্যন্ত ঠিক করতে পারিনি ঢাকায় গিয়ে কোথায় উঠবো। ঢাকাতে আমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। বন্ধুদের নিয়ে একসাথে উঠবো বলে বাসা খোঁজ করছি দুমাসের জন্য, এখনো পাচ্ছি না। অল্প সময়ের জন্য কেউ বাসা ভাড়া দিচ্ছেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকা কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মিল্টন হোসাইন ও রাবিউস সানি রিয়াদ বলেন, পরীক্ষা ঘোষণার পর রুটিন প্রকাশ করলেও এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ আমাদের পরীক্ষার মানবণ্টন জানাতে পারেননি। কীভাবে পরীক্ষা হবে আমরা এখনো জানি না। এর মধ্যে ঢাকায় এসে কীভাবে থাকবো চিন্তায় আছি। বাড়িতে থেকে ভালোভাবে অনলাইন ক্লাস করতে পারিনি, অন্যদিকে এখন থাকার চিন্তা। দুই মিলে মানসিক যন্ত্রণায় আছি।

ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ‘আমরা হল খুলে দেয়ার জানাচ্ছি। আমাদের দাবি আমাদের অবস্থান কর্মসূচি আরও দীর্ঘ হবে। দাবি পূরণে দেরি হলে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।’

এ নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘হাট-বাজার, লঞ্চঘাট, অফিস-আদালত— সবকিছুই পূর্ণোদ্যমে চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে সমস্যা কোথায়?’ ‘করোনার শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মঘণ্টা কমিয়ে দিয়ে কাজ করা হয়েছিল। তখন একটা যুক্তি ছিলো। এখন কিন্তু সব পুরোদমে চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলেও স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে লেখাপড়ার বাইরে। তারা মানসিকভাবে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ থাকে না। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা এখন পর্যন্ত আমরা সারা দেশে নিশ্চিত করতে পারিনি। এখন পর্যন্ত সেই অবকাঠামোই আমরা শক্তিশালীভাবে গড়ে তুলতে পারিনি। এর মধ্যে হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা তা কোনোভাবে ঠিক হচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে ডাকসুর সদ্য সাবেক এজিএস সাদ্দাম হোসেন ফেসবুকে লেখেন— ‘আবাসনের নিশ্চয়তা না দিয়ে শিক্ষার্থীদের চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা ও মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত একতরফা, এটা শিক্ষার্থী স্বার্থবিরোধী এবং বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যহীন। সেশনজট নিরসনকল্পে এবং বিসিএসসহ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের জন্য পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা চিন্তা করেই অনার্স ফাইনাল ও মাস্টার্সের পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, যাতে আমাদের ছেলে-মেয়েরা পিছিয়ে না থাকে।’ তিনি বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খোলা হবে না। ‘আবাসিক হল খুলতে জাতীয়ভাবে সিদ্ধান্ত আমাদের লাগবে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের মতামত লাগবে। আবাসিক হল খোলা জাতীয় সিদ্ধান্তের বিষয়।’

আমারসংবাদ/জেআই