Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

বিপাকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি

এএইচএম কাউছার, চট্টগ্রাম

জানুয়ারি ১৪, ২০২১, ০৫:১৫ এএম


বিপাকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে বেশ বিপাকেই পড়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কারসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়ার পরও এখনো নিজেদের সিদ্ধান্তেই অনড় রয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠে বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন তারা। এর প্রভাব পড়তে পারে এবার নির্বাচনের ফলাফলেও।

আগামী ২৭ জানুয়ারি চসিক নির্বাচন। এই নির্বাচনে সাতজন মেয়রপ্রার্থী নিজ নিজ দল থেকে একক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন। মেয়র পদে কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকলেও কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীরা এখনো নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন। তাদের নানাভাবে বুঝিয়ে এমনকি দল থেকে বহিষ্কারসহ কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েও নির্বাচন থেকে সরানো যাচ্ছে না। ফলে নগরীর সাধারণ ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশেই এবার দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্ত বিরোধিতার মুখে পড়তে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা। এর মধ্যে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত ১৫টি ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলরদের মধ্যে ১১ জনই ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়ে নির্বাচনি মাঠে আছেন। এর বাইরে বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা প্রার্থী হিসেবে রয়ে গেছেন।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত চসিকের সর্বশেষ নির্বাচনে ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৫টিতে এবং সংরক্ষিত ১৪টির মধ্যে ১১টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন। এবার অধিকাংশ ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগের মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থীকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। এ কারণে গতবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীর বিজয়ী হওয়াটা এবার কঠিন হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীরা সরে না দাঁড়ালে ফলাফল মনোনীত প্রার্থীদের অনুকূলে না-ও আসতে পারে।

এ কারণেই বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘বিদ্রোহীদের কোনো ছাড় নেই। বিদ্রোহীদের মধ্যে যাদের পদ-পদবি আছে, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। যাদের পদ-পদবি নেই, তারা আমাদের কেউ নয়, তারা বহিরাগত।’ তিনি বলেন, ‘নৌকার মেয়র প্রার্থী এবং দল থেকে যাদের কাউন্সিলর প্রার্থী দেয়া হয়েছে, সেটা নেত্রীর (আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্ত। এটার ওপর কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। নেত্রীর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য এবং দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য যা যা করার প্রয়োজন তা করা হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরদের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে নির্বাচন করা হবে। মহানগর, থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কেউ যদি বিদ্রোহীদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করে, তাদেরও বহিষ্কারের সুপারিশ করা হবে।’ নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘নির্বাচনে সব শক্তি নিয়ে নেতা-কর্মীদের মাঠে থাকতে হবে। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের কাজ করতে হবে। কোনো ধরনের মতানৈক্য ও বিরোধ বিভ্রান্তি রাখা যাবে না। মনে রাখতে হবে, প্রার্থী দলের মনোনীত, এই প্রার্থী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের, এই প্রার্থী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। আওয়ামী লীগ যদি সম্মিলিত শক্তি নিয়ে কাজ করে, তাহলে বিরোধী কোনো শক্তি দাঁড়াতে পারবে না।’

নগরীর ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গি বাজার ওয়ার্ড থেকে গতবারের বিজয়ী কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব এবার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন। এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনকে।

মনোনয়ন না পাওয়ার পরও নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, ‘দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামত নেয়া হয়নি। আমি গতবার দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়ে এই ওয়ার্ডের লোকজনের নিরলস সেবা করেছি গত পাঁচটি বছর। করোনা মহামারিতেও এলাকাবাসীর পাশে ছিলাম। নিজের জীবনের মায়া করিনি। পরিবারের ছোট সন্তানটির কথাও ভাবিনি। সরকারের নির্দেশনা মেনে এলাকাবাসীর পাশে থেকে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছি। এটি করতে গিয়ে আমি নিজে করোনায় আক্রান্ত হয়েছি। আমার পরিবারের সদস্যরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। তারপরও আমি এলাকাবাসীর সেবা করে গেছি। এ কারণে এলাকার মানুষও চায় আমি আবারো এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হই। তারাই আমাকে নির্বাচন করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তাদের অনুরোধেই এই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী বলেন, ‘বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে এত ভয় কেন? এলাকায় যার জনপ্রিয়তা বেশি, তিনিই নির্বাচিত হবেন। জনপ্রিয়তা যাচাই না করেই জোর করে অযোগ্য প্রার্থীকে দল থেকে মনোনয়ন দিলে সেটি এলাকাবাসী কেন মেনে নেবে? ভোটের মাধ্যমে তাদের মতামত দেয়ার অধিকার রয়েছে। সেই সুযোগটি তাদের দেয়া উচিত।’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের উচিত বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে কীভাবে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ানো যায়, সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন উপহার দেয়া যায়, সেই চেষ্টা করা।’ চসিকের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী মোহাম্মদ শফিউল আজিম। এই ওয়ার্ডে নির্বাচনি মাঠে ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে সক্রিয় আছেন সাবেক কাউন্সিলর তৌফিক আহমেদ চৌধুরী। ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে মহানগর যুবলীগের সদস্য মোহাম্মদ ইব্রাহীমকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মাঠে আছেন সাবেক কাউন্সিলর সাহেদ ইকবাল। ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে মনোনয়ন পেয়েছেন মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য আবুল হাসনাত মোহাম্মদ বেলাল। সেখানে মাঠে আছেন সাবেক কাউন্সিলর কবির আহমদ মানিক।

এর বাইরেও ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড, ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ড, ২৫ নম্বর রামপুর ওয়ার্ড ও ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডসহ বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচনি মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। পিছিয়ে নেই সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর বিদ্রোহী প্রার্থীরাও। ৩ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডে প্রথমে আওয়ামী লীগ থেকে জোহরা বেগমকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়। পরে সেখানে বিদ্রোহী হিসেবে মাঠে থাকা সাবেক কাউন্সিলর জেসমিন পারভীন জেসিকে দল থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়।

এখন ছিটকে পড়া জোহরা বেগম বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে সক্রিয় আছেন মাঠে। ১৬, ২০ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে রুমকী সেনগুপ্তকে দল থেকে মনোনয়ন দেয়া হলেও সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন সাবেক কাউন্সিলর আনজুমান আরা। একইভাবে ৪ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ড, সংরক্ষিত ৯ নম্বর ওয়ার্ড, ২৮, ২৯ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডসহ কয়েকটিতে বেশ কয়েকজন বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন নির্বাচনি মাঠে।

এদিকে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়ালে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম বলেছেন, ‘বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আগেই কেন্দ্রে সুপারিশ করেছিলাম। মাঝখানে নির্বাচন স্থগিত থাকায় সে বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি। একাধিকবার বিদ্রোহীদের সরে যেতে বলেছি। নির্বাচন থেকে তারা এরপরও সরে না দাঁড়ালে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

জানা গেছে, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি নগরীর ৪১ জন কাউন্সিলর এবং ১৪টি সংরক্ষিত আসনে মহিলা কাউন্সিলর পদে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে বিএনপির মনোনয়ন বোর্ড। এর মধ্যে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিএনপির পাঁচজন বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন নির্বাচনি মাঠে। এর মধ্যে শুধু ২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডেই আছেন দুই প্রার্থী। তারা হচ্ছেন— আজিজুর রহমান বাবুল ও মহসীন আলী চৌধুরী। এর মধ্যে মহসীন আলী চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করেছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। কিন্তু নগর বিএনপির গঠিত মনোনয়ন বোর্ড তাকে সমর্থন দেয়নি। এই ওয়ার্ডে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হচ্ছেন মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও বর্তমান কাউন্সিলর মো. আবুল হাশেম। নগর বিএনপির সদস্যসচিব আবুল হাশেম বক্কর বলেন, ‘বিদ্রোহীদের সরে যেতে আগে চিঠি দিয়েছিলাম। এখন আবার দেবো। সরে না গেলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা একসঙ্গে প্রচার চালাবেন। কাউন্সিলর প্রার্থীদের সঙ্গে ওয়ার্ড বিএনপির দূরত্ব থাকলে সেটা ঘুচিয়ে নিতেও নির্দেশনা দিয়েছি।’ প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৯ মার্চ চসিক নির্বাচনের কথা ছিলো। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে নির্ধারিত তারিখের এক সপ্তাহ আগে ভোট স্থগিত করা হয়। নির্ধারিত সময়ে ভোট করতে না পারায় ৬ আগস্ট সরকার মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজনকে চসিকের প্রশাসক হিসেবে ১৮০ দিনের জন্য দায়িত্ব দেয়। এরপর গত ১৪ ডিসেম্বর নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আগামী ২৭ জানুয়ারি চসিক নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে নগরীর ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ১৬১ জন এবং সংরক্ষিত ১৪টি ওয়ার্ডে মহিলা কাউন্সিলর পদে ৫৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। এসব প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন ১১০ জন। বাকিরা দুই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী।

আমারসংবাদ/জেআই