Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

মানুষের রাজনীতি বিধ্বস্ত!

আবদুর রহিম ও রফিকুল ইসলাম 

জানুয়ারি ১৪, ২০২১, ০৬:৩০ পিএম


মানুষের রাজনীতি বিধ্বস্ত!

নেই মানুষের স্বার্থে রাজনীতি। জনগণের ইস্যুতে নীরবতা। উপেক্ষিত জনগণের স্বার্থ। বিধ্বস্ত রাজনীতির ব্যাকরণ। মানুষ নিয়ে রাজনীতি এখন প্রায় কফিনে! নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে বাসাভাড়া, বাসভাড়া, তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে মানুষের অবস্থা করুণ। গরিবের আলু, পেঁয়াজ ও সবজির দাম রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এ নিয়ে কথা বলছেন না কেউ। প্রতিদিনই রাজনৈতিক ব্যানারে হচ্ছে প্রতিবাদ কিংবা কোনো সভা-সমাবেশ। থাকছে দলীয় স্বার্থ, ক্ষমতার স্বার্থ। শুধু থাকছে না মানুষের পক্ষের কথা। করোনাকালে বাসাভাড়া দিতে না পেরে অনেক মধ্যবিত্ত গ্রামে চলে গেছেন।

গ্রামে গিয়েও শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। মাস শেষে টাকা নেই। পরিবার-সমাজে লজ্জায় দিন কাটছে লাখো পরিবারের। এর মধ্যে প্রতিদিনই বাসাভাড়া, শিক্ষার ব্যয় বাড়ায় মানুষিক যন্ত্রণায় অভিভাবকরা। করোনায় বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোনোমতে যারা অনলাইনে ক্লাস করছে তাদেরও দিনশেষে মোটা অঙ্কের ফি দিতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে চিকিৎসা খাতের ব্যয়বহুলতা শুধুই বাড়ছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে অনেক পরিবারই পথে বসেছে।

নিত্যপণ্যের বাজারে চাল-আটা, মাছ-মাংসসহ, সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় মহাসংকটে দিন পার করছে লাখ লাখ নিম্ন আয়ের মানুষ। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চোখ রাখা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরিবরা রাস্তায় নেমেছে সাহায্যের জন্য, আর মধ্যবিত্তরা লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে। এছাড়া সমপ্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপও বলছে, ‘কোভিড-১৯ এর কারণে দরিদ্র মানুষের বেহাল অবস্থা। নবদরিদ্র ও অতিদরিদ্র সৃষ্টি হয়েছে পাঁচ কোটি ৯৫ লাখ বা প্রায় ছয় কোটি।

মধ্যবিত্তের শতকরা ৬০ ভাগ করোনাকালে বিপদে রয়েছে। এছাড়া করোনার আগে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২০.৫ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিলো আর চরম দরিদ্র ছিলো ১০ ভাগ। করোনাকালে এ পরিসংখ্যান বদলে গেছে। দরিদ্র বেড়েছে শতকরা ১০ ভাগ। এ নিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভাষ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মৃল্যবৃদ্ধি সরকারের ব্যর্থতা নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা।

সরকার সব সময় চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার, তবুও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু যারা বিরোধী দলে থাকে, তাদের দায়িত্ব এগুলো তুলে ধরা, কিন্তু তারা তা ধরছে না। কেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে এটিও অজানা। এ বিষয়ে কেউ কথা বলছে না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। এও বলা হচ্ছে, এদেশে এখন বিরোধী দল বলে কিছু নেই, সরকার চায় না বিরোধী দল থাকুক। ফলে বর্তমান সরকারের ভুলভ্রান্তি তুলে ধরার লোকও নেই। তাই অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোতে এখন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছে দেশের মানুষ। সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা ছাড়ার পথ রুদ্ধ হয়েছে। এছাড়া বড় রাজনৈতিক দলগুলো কখনো গরিববান্ধব নয়, তারা সব সময় ব্যবসায়ী ও বড়লোক বান্ধব রাজনৈতিক দল। তারা কখনো কখনো সুযোগ-সুবিধা ও মানুষের সমর্থনের জন্য বলবে, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে চুপ থাকবে।

মানুষের জন্য রাজনীতি না হওয়ার পেছনে ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে মূল হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বিএনপির পর ক্ষমতাসীন দলের বিরোধও প্রকাশ্যে এসেছে। ভোটের ঘুঁটি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টিও প্রাণহীন। বাম দলগুলোও অতীত ঐতিহ্য হারিয়েছে। এখন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব কিংবা প্রেস ক্লাবে মানববন্ধনেও দেখা যায় না। মানুষের পক্ষে অধিকার নিয়ে বিবৃতিও কমেছে এই দলে।

ভোট এলে অসহায়ত্বের ভূমিকায় দেখা মিলে এক সময়ের ক্ষমতাধর বিএনপিকে। অভিযোগ, নালিশ, দোয়া, মিলাদ, মাঝে মধ্যে প্রেস ক্লাবে মানববন্ধন করেই দলীয় কর্মসূচি পালন করে দিনক্ষণ পার করছে। সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের সমালোচনায় ব্যস্ত বিএনপির রাজনীতি। চুপ মানুষের চাহিদার দাবি নিয়ে। তবে তারেক রহমান ইস্যুতে প্রেস ক্লাবসহ দলীয় কার্যালয়ে নানা ঘরোয়া কর্মসূচিতে দেখা যায়। ইসলামি দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীকে এক সময় নানান ইস্যুতে সরব দেখা গেলেও যুদ্ধাপরাধীর কলঙ্কে শীর্ষ নেতাদের হারানোর পর এ দলটিও প্রায় হারিয়ে গেছে। হেফাজতসহ কয়েকটি ইসলামি দল ধর্মীয় ইস্যুতে সাময়িক সরব দেখা গেলেও মানুষের অধিকারের ইস্যুতে একেবারেই চুপ।

এদিকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আ.লীগই এখন নিজ দলে প্রতিপক্ষ। লাভে লোভে কোন্দল বাড়ছেই। সমপ্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন শেখ পরিবারের এক মেয়রকে বলেন, তাপস ডিএসসিসি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলাবাজি করে চলেছেন। আমি তাকে বলবো, রাঘববোয়ালের মুখে চুনোপুঁটির গল্প মানায় না। কেননা দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে হলে সর্বপ্রথম তার নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। অথচ তিনি উল্টো কাজ করছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর তাপস ডিএসসিসির শত শত কোটি টাকা তার নিজ মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করেছেন। তার এ বক্তব্য রাজনীতির মাঠে বিব্রত সরকারি দল আওয়ামী লীগ।

এদিকে নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়রপ্রার্থী আব্দুল কাদের মির্জা নিজ দলের এমপি ও ভাই দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে একের পর এক মন্তব্য করে যাচ্ছেন। গণমাধ্যমে প্রতিদিনই ওবায়দুল কাদেরের ভাইয়ের কথা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ হচ্ছে। গণতন্ত্র না থাকা, দুর্নীতি, ভোট চুরি, ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে বলে দাবি করে তিনি কথা বলছেন। বিএনপির জনপ্রিয়তার কথাও বলছেন।

এ নিয়ে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ আমার সংবাদকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মৃল্যবৃদ্ধি সরকারের ব্যর্থতা নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা। সরকার সব সময় চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার, তবুও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু যারা বিরোধী দলে থাকে, তাদের দায়িত্ব এগুলো তুলে ধরা। দেশের জনগণের স্বার্থে কথা বলা। কিন্তু তারা আজ সেই কথাগুলো বলতে চায় না। বিরোধীরা শুধু চিন্তা করেন, এ ভালো না, আমাকে ভোট দেন, আমরা ক্ষমতায় এলে দেশটা সোনায় ভরিয়ে দেবো ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কেন নিত্যপ্রায়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়ে কেউ কথা বলছে না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স আমার সংবাদকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কথা বলছে না, এটা ঠিক নয়। বামপন্থি দলগুলো সবসময় কথা বলছে। বামপন্থিরা আরও বড় করে এই আন্দোলন গড়ে তুলবে।

তিনি আরও বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি নিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কথা আশা করা যায় না। কারণ দাম বৃদ্ধি নিয়ে তাদের কোনো আসে যায় না। তাই তারা এটা নিয়ে কোনোভাবেই কথা বলবে না। কারণ বড় রাজনৈতিক দলগুলো কখনো গরিব বান্ধব নয়, তারা সব সময় ব্যবসায়ী ও বড়লোক বান্ধব রাজনৈতিক দল। তারা কখনো কখনো সুযোগ-সুবিধা ও মানুষের সমর্থনের জন্য বলবে, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে চুপ থাকবে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আমার সংবাদকে বলেন, এই সরকার জনগণের ঘাড়ে চেপে দেশকে লুটেপুটে ফোকলা করছে। খুন-গুম, হামলা-মামলা, নিপীড়ন ও সকল অধিকার হরণের মাধ্যমে মানুষের জীবনকে বিষময় করে তুলেছে। মানুষ এখন এই সরকারের নির্যাতনে বিধ্বস্ত।

আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মোজাফফর হোসেন (পল্টু) আমার সংবাদকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করছে সরকার। এর মাঝেও কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীচক্র সক্রিয় রয়েছে। সরকারও তাদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। তাহলে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম সরকার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে এ জন্যই রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বলার দরকার হচ্ছে না। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এ বিষয়ে আমার সংবাদকে বলেন, এদেশে এখন বিরোধী দল বলে কিছু নেই, সরকার চায় না বিরোধী দল থাকুক। ফলে বর্তমান সরকারের ভুলভ্রান্তি তুলে ধরার লোকও নেই। তাই অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা অনৈতিক, অযৌক্তিক এবং সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত। এটা দেশের জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজ।

এ বিষয়ে রাজনৈতিক ও স্থানীয় সরকার বিশ্লেষক এবং সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোতে এখন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছে দেশের মানুষ। সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা ছাড়ার পথ রুদ্ধ হয়েছে।

আমারসংবাদ/জেআই