Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

জোরালো হচ্ছে আনুশকা হত্যার প্রতিবাদ

নুর মোহাম্মদ মিঠু

জানুয়ারি ১৪, ২০২১, ০৭:৫০ পিএম


জোরালো হচ্ছে আনুশকা হত্যার প্রতিবাদ

রাজধানী ধানমন্ডির মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ছাত্রী আনুশকা নুর আমিনকে ধর্ষণের পর হত্যার প্রতিবাদে ধীরে ধীরে উত্তাল হয়ে উঠছে তার সহপাঠী ও বিভিন্ন নারী সংগঠনের আন্দোলন। আনুশকার সহপাঠী ও বেশকটি নারী সংগঠন আনুশকা হত্যার ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তির সৃষ্টি, অভিযুক্ত তানভীর ইফতেখার দিহানের বয়স নিয়ে লুকোচুরি ও তার সঙ্গীদের আসামি না করায় আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে উঠছে।

গতকাল বৃহস্পতিবারও মাস্টারমাইন্ড স্কুলের সামনে মানববন্ধন করে আনুশকার সহপাঠীরা। সেখানে তারা চার দফা দাবি জানিয়ে বিভিন্ন স্লোগান ও ব্যানার পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে প্রতিবাদে আনুশকার চরিত্রহননের কুৎসিত ধারা বন্ধের দাবিও জানায়। এছাড়াও ধর্ষণ ও হত্যামামলায় পুলিশের পরামর্শেই দিহানকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন আনুশকার মা।

গতকালের মানবন্ধনে আনুশকার সহপাঠী ও নারী সংগঠনের নেত্রীরা বলেন, ধর্ষণের শিকার হলে আনুশকার চরিত্রহননের কুৎসিত ধারা বন্ধ করা দরকার। ধর্ষণের শিকার হলেন যে শিক্ষার্থী তার নাম তো বটেই, সাতদিন ধরে ছবিও দেখানো হলো গণমাধ্যমে। চরিত্র নিয়ে কাঁটাছেড়া চললো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। চরিত্রহননের এই ধারা বন্ধ করতে হবে। মানববন্ধনে আনুশকার মা দাবি করেন, তার মেয়ের শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ছিলো।

মানববন্ধনে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা শুধু একজনের ছবি দেখতেছি। একজনের ঠিকানা পাচ্ছি সে হচ্ছে তানভীর ইফতেখার দিহানের। বাকি তিনজনের সম্পর্কে কিছুই জানা যাচ্ছে না। এদিকে নির্যাতিতার মা বলেন, ওই ঘটনায় দিহানসহ আরও তিনজন ছিলো। আমাদের বক্তব্য ছিলো বাকিদের আসামি করা হোক। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন আমাদের বক্তব্য এড়িয়ে শুধু দিহানকে আসামি করে। বিচার হয় না বলেই ধর্ষণ বন্ধ হয় না— এমন মন্তব্য করে নির্যাতিতার সহপাঠীরা আরও বলেন, দিহানের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। দিহানের তিন বন্ধুর ছবি প্রচার করারও দাবি জানান তারা।

এদিকে গত ৮ জানুয়ারি থেকে আনুশকার সহপাঠীরা তাদের সহপাঠী ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছে। তারা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়টি নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। একদিকে অপরাধের শিকার সহপাঠীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে অন্যদিকে অভিযুক্তের বয়স ও তার সহযোগীদের পরিচয় আড়াল করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিছু কিছু সময় এই ঘটনা তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সাক্ষাতকার বিকৃত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যে কারণগুলোর জন্য আমরা আজ সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও আনুশকার পরিবারের পক্ষ থেকে চার দফা দাবি নিয়ে হাজির হয়েছি।

এর প্রথমটি— দ্রুত ও ন্যায্য বিচারপ্রক্রিয়া, যা দুর্নীতি ও কালো প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে। আমরা চাই, আনুশকা আমিনের মামলার বিচারকাজ যেন দ্রুত বিচার আইনের আওতায় আনা হয়। ফারদিন ইফতেখার দিহান ও তার সঙ্গীদের যেন দ্রুত ও ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচারের আওতায় আনা হয়। আমরা চাই না ভিকটিমের পরিবার কোনো প্রকারের অযাচিত অসুবিধার শিকার হোক।

দ্বিতীয়টি— সরকারকে অবশ্যই ভিকটিমের পরিবারকে তদন্ত প্রক্রিয়ায় সব রকম সহায়তা প্রদান করতে হবে। আমরা চাই সকল তদন্ত প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা এবং ভিকটিমের পরিবারকে নিয়মিত এ সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করা হোক।

আমরা আরও চাই, একটি স্বচ্ছ ও সঠিকভাবে ডিএনএ পরীক্ষা কার্যকর করা হোক এবং সেই সাথে দিহানের সাথে হাসপাতালে উপস্থিত অপর তিনজনের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারেও পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ করা হোক। যথাসময়ে স্বচ্ছ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গিয়ে ভিকটিমের পরিবার যেন কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয়— এ ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা চাই। সর্বোপরি, ভিকটিমের পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শারীরিক ও রাজনৈতিকভাবে নিরাপত্তা দিতে হবে। যেন তদন্ত প্রক্রিয়া সকল প্রকার অনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকে।

তৃতীয়ত— বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, মানহানি ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো, আলোকচিত্র প্রকাশ করা এবং কোনো ব্যক্তিকে অপমান বা হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা তথ্য প্রচারের সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর কারাদণ্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। ভিকটিমের বয়সের ব্যাপারে যারা মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে এবং সেই সাথে ভিকটিমকে দোষারোপের মাধ্যমে তার চরিত্রহননের চেষ্টা চালাচ্ছে, সাইবার ক্রাইম ইউনিট যেন তাদের শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা নেয়, তা নিশ্চিত করার জন্যে আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। চতুর্থ— সরকার কর্তৃক দেশের পথে-ঘাটে নারীর জন্যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং জনগণকে ইতিবাচক সম্মতি সম্পর্কে শিক্ষাপ্রদানে নিবেদিত হতে হবে। 

এদিকে আনুশকার মৃত্যুর আগে-পরে কী ঘটেছিল— তার অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়েছে গণমাধ্যমের হাতে আসা একটি সিসিটিভি ফুটেজে। ওইদিন দিহানের বাসা ও হাসপাতালের পাঁচটি সিসিটিভির ফুটেজ পেয়েছে গণমাধ্যম। ফুটেজে আনুশকার ওই বাসায় ঢোকা এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়ের পরিষ্কার চিত্র পাওয়া গেছে।

দিহানের বাসার উল্টোদিকের একটি ভবন থেকে পাওয়া সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঘটনার দিন দুপুর ১২টার কিছু সময় পর কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে একটি ছেলে (যাকে দিহান বলে ধারণা করা হচ্ছে) ও একটি মেয়ে বাসার মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করে সিঁড়ি ঘরের দিকে চলে যাচ্ছেন। সিসিটিভি ক্যামেরাটি কিছুটা দূরে থাকায় এ ফুটেজ অনেকটা অস্পষ্ট।

এছাড়া, ক্যামেরার সামনে একটি গাছের প্রতিবন্ধকতা থাকায় এরপর অচেতন অবস্থায় মেয়েটিকে বাসার পার্কিং এরিয়ার গাড়িতে তোলার দৃশ্যটি ধরা পড়েনি। তবে মেয়েটি বাসায় ঢোকার প্রায় এক ঘণ্টা পর হাসপাতালগামী দিহানের গাড়ির দৃশ্য পরিষ্কার ধরা পড়েছে ডলফিন গলির মুখের আরেকটি সিসিটিভি ক্যামেরায়। একটি আবাসিক ভবনের ওই সিকিউরিটি ক্যামেরায় দেখা যায়, বেলা ১২টা ৫২ মিনিটে দিহানের টয়োটা এক্সিও গাড়িটি (ঢাকা মেট্রো গ ২৯-৪৮১৭) বাসার মূল ফটক থেকে বেরিয়ে বাম দিকের রাস্তা ধরে হাসপাতালের উদ্দেশে যাচ্ছে। গাড়িটি কে চালাচ্ছিলেন বা আরোহীর বিষয়টি এ ফুটেজেও পরিষ্কার। পেছনের জানালার গ্লাস অস্বচ্ছ থাকায় পেছনের সিটে মেয়েটির অবস্থানও নিশ্চিত করা যায়নি।

তবে দিহান ও বাসার দারোয়ান দুলাল হোসেন আদালতে তাদের জবানবন্দিতে বলেছেন, মেয়েটিকে অজ্ঞান অবস্থায় তারা দুজন মিলে গাড়ির পেছনের সিটে তুলেছিলেন। এরপর দিহান একাই গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে যান। পরের ফুটেজটি আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রবেশমুখের। এতে দেখা যায়, দুপুর ১টা ৫ মিনিটে হন্তদন্ত হয়ে দিহান হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রবেশ করছেন এবং সেখানকার কর্মীদের কিছু একটা বলেছেন।

আদালতে দেয়া জবানবন্দি অনুযায়ী, সে সময় দিহান হাসপাতালের কর্মীদের বলছিলেন, ‘গাড়িতে গুরুতর রোগী আছে। তাকে আনতে সাহায্য লাগবে।’ এরপরই একটি হুইল চেয়ার নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একজন কর্মী বেরিয়ে যান, তার সঙ্গে দিহান ও আরও কয়েকজন কর্মী গাড়ির কাছে যান। এর দেড় মিনিট পর (১টা ৬ মিনিট) হুইল চেয়ারে করে মেয়েটিকে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন দুই কর্মী। পেছন পেছন ছুটে আসেন দিহান।

আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আসিরসহ নার্স ও স্টাফরা প্রায় ৪৬ মিনিট ধরে মেয়েটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী, ব্লাড প্রেশার, পালস না পাওয়ায় তাকে সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) দেয়া হয়। তবুও হার্ট সচল না হওয়ায় সবশেষ ইসিজি করে কর্তব্যরত চিকিৎসক নিশ্চিত হন মেয়েটি মারা গেছেন।

ডেথ সার্টিফিকেট অনুযায়ী, দুপুর ১টা ৪৩ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। দিহানের ফোন পেয়ে মেয়েটির মা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছেন দুপুর দেড়টার কিছু সময় পর। এ দৃশ্যও সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। এরপর একে একে আসতে থাকে মেয়েটির অন্যান্য স্বজন। এর আগে দিহানের তিন বন্ধু হাসপাতালে পৌঁছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ফোন পেয়ে কলাবাগান থানা পুলিশ আসে দুপুর ২টার দিকে।

পুলিশ এসেই দিহান ও তার তিন বন্ধুকে হেফাজতে নেয়। তাদের জরুরি বিভাগের স্টোর রুমে রেখে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ২টা ৩৯ মিনিটে হাসপাতালে আসেন মেয়েটির বাবা। মেয়ের মরদেহ দেখে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। চলতে থাকে বাবা-মায়ের আহাজারি। ২টা ৪৭ মিনিটে দিহানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হাতকড়া পরিয়ে জরুরি বিভাগের স্টোররুম থেকে বের করে দিহানকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দিহানের তিন বন্ধুকেও একই সময়ে আটক করতে দেখা যায়। এর এক ঘণ্টা পর হাসপাতাল ছাড়ে মেয়েটির পরিবার। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

আমারসংবাদ/জেআই