Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

মুজিববর্ষ হোক তারুণ্যের অনুপ্রেরণা

রায়হান আহমেদ তপাদার

জানুয়ারি ২১, ২০২১, ০৭:৩৫ পিএম


মুজিববর্ষ হোক তারুণ্যের অনুপ্রেরণা

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনিও বাবার মতোই আপসহীন বলিষ্ঠ চিত্তের। তারও শক্তির একমাত্র উৎস দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে ঢুকতে না দেয়া, একাধিকবার হত্যাচেষ্টা, একুশ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেডহামলা, যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু ইত্যাদি ঘটনার কোনো কিছুই তার চলার পথকে রুদ্ধ করতে পারেনি, তাকে ভীত করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, কিন্তু স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়া তার হয়নি। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছি। বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হলেও মাথা পেতে নেবো’

জাতির জনকের সংগ্রামী জীবন থেকে ২১ শতকের তরুণ প্রজন্মের ধারণ করার মতো আছে অনেক কিছুই। বঙ্গবন্ধুর জীবনী আমাদের প্রজন্মকে শিক্ষা দেয় অনেক বাধা-বিপত্তির মাঝেও সততা এবং সাহসিকতায় অটল থাকতে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্পষ্টভাষী। যেকোনো পরিস্থিতিতে যে কারো সামনে বঙ্গবন্ধুর স্পষ্টভাষিতা আমাদের প্রজন্ম ধারণ করতে পারে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে।’ অতি সাধারণ জীবন যাপন এবং শ্রেণিনির্বিশেষে মানুষকে কাছে টেনে নেয়া ও ভালোবাসার শিক্ষাটা আমরা ধারণ করতে পারি জাতির জনকের জীবনী থেকে, যা একুশ শতকে দুর্লভ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টির সাথে অবিভাজ্যভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, সামরিক শাসনবিরোধী বক্তব্য প্রদান, ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, বাঙালির স্বাধীনতার ঘোষণা প্রভৃতি ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। ইতিহাস যেমন নেতৃত্ব সৃষ্টি করে, নেতৃত্বও তেমনি ইতিহাস সৃষ্টি করে। মূলত বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির চেতনার এক অনির্বাণ শিখা। তরুণদের নাড়ির স্পন্দন, আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা তিনি সহূদয়ে বুঝতে পারতেন।

তাই তরুণদের নিয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠন করেন ‘ছাত্রলীগ’। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দেশের মানুষকে না গড়ে, দেশের মানুষকে মবিলাইজড না করে আদর্শ নিয়ে চলা যায় না। তাই তরুণদের চিন্তা-চেতনায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মুক্তিবার্তা। তার লেখা বই অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা আজকের তরুণদের কাছে মুক্তির বার্তা ও প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সমাদৃত। তারুণ্যের প্রতি তার বিশ্বাস ছিলো অবিচল। যার অন্তরঙ্গ প্রমাণ এ বই দুটি। তিনি তরুণদের বলছেন, ‘যেখানে অন্যায়-অবিচার, সেখানে প্রতিবাদ কর, মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ক্ষমতা এবং স্বার্থের ঘর বড় করে তাদের প্রতিরোধ কর। তিনি বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতেন। মানুষে মানুষে বিভাজনকে ঘৃণা করতেন। তার দর্শন ছিলো এক বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও ধর্মনিরপেক্ষতায় আদর্শ মানবতার উদ্দীপনা। তিনি বাঙালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি, যার জীবনের সবটুকু সময় ব্যয় করেছেন বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠায়। তিনি ২৩ বছরের নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত অসহায় মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করতেন। যার এক ডাকে জড়ো হতো ৭ কোটি বাঙালি। যাকে বাঙালি ছাত্রসমাজ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছেন। যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টি হতো না। তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির জাতির পিতা। সকলের বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন প্রতিবাদী। অন্যায় দেখলে আপস করতেন না। কোনো কিছুর কাছেই তিনি মাথা নত করেননি। তিনি ভালোবাসতেন দেশের মানুষকে।

দেশের মানুষও ভালোবাসত বঙ্গবন্ধুকে। তার শক্তির উৎস হচ্ছে বাঙালির প্রতি ভালোবাসা এবং তার আপসহীনতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যেকোনো দিন তাকে ফাঁসি দিতে পারতো পাকিস্তানি শাসকরা। এমনকি কবর খোঁড়া হয়েছিল তার জন্য। নির্ভীক বঙ্গবন্ধু সেই কবর দেখে বলেছিলেন, ‘আমিতো জানি তোমরা আমাকে ফাঁসি দেবে। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। বাংলার দামাল ছেলেরা যখন হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে শিখেছে, তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে পৃথিবীর কোনো শক্তি নাই দমিয়ে রাখে। তবে তোমাদের কাছে অনুরোধ- তোমরা আমাকে এই কবরে কবর দিয়ো না, আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ো।’ বঙ্গবন্ধু জানতেন, বাংলার মানুষ এ দেশকে স্বাধীন করতে পারবেই। স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুও প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আপসহীনতার কারণ হলো জনগণের অধিকার। সাধারণ মানুষের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর আপস ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি জানতেন যেকোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার হবেন। কিন্তু পালিয়ে যাননি। কারণ পালায় কাপুরুষ, ভীরুর দল। বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের আস্থা শতভাগ ঠিক ছিলো। জনগণকে রেখে সত্যিকারের নেতা পালাতে পারে না। বঙ্গবন্ধু চাইলে পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে আপস করে আরাম-আয়েশের জীবন বেছে নিতে পারতেন। তার কাছে বরং জেলজীবন এর চেয়ে উত্তম মনে হয়েছে। তাই জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি আমৃত্যু ছিলেন আপসহীন। ১০ জানুয়ারি বাঙালি জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় মাহেন্দ্রক্ষণ।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তার প্রিয়ভূমি স্বাধীন স্বদেশে মহাপ্রতাপে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বাধীন দেশে বীরের বেশে মহান নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগমন ঘটে নিজ মাতৃভূমি প্রিয় দেশে। তাই ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর বিশ্বনেতাদের চাপের মুখে পরাজিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বন্দিদশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লন্ডন-দিল্লি হয়ে তিনি ঢাকায় পৌঁছেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি বিমানবন্দরে কখন অবতরণ করবে সে অপেক্ষায় পুরো বিমানবন্দর এলাকা যেন পরিণত হয় এক মহামিলন মেলায়। স্বাধীন দেশের মাটিতে পা স্পর্শ করবেন তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সে আনন্দে মাতোয়ারা প্রতিটি পথ-প্রান্তরে অপেক্ষমাণ কোটি বাঙালি। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বিজয়ীবেশে পা রাখলেন লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত স্বাধীন বাংলার মাটিতে। পুরো বঙ্গরাজ্য ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে স্বাগত জানায় তাদের প্রিয় নেতাকে। প্রিয়ভূমের মৃত্তিকাবক্ষে পা রেখেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। দীর্ঘ ৯ মাস পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের গণহত্যার সংবাদ শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বঙ্গবন্ধু তার দেশে ফেরা সম্পর্কে বলেছিলেন, এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় অভিযাত্রা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একথাগুলো বাঙালি চেতনায় নতুনভাবে আশার সঞ্চার করতে সচেষ্ট হয়েছিল সেদিন। সুখী ও সমৃদ্ধশালী একটি বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে দেশ পরিচালনায় নিজেকে মেলে ধরার আগেই এ দেশীয় কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে স্বাধীন বাংলার স্থপতিকে। স্তব্ধ হয় পুরো জাতি। ঢুকরে কেঁদে ওঠে বাঙালি এবং বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনিও বাবার মতোই আপসহীন বলিষ্ঠ চিত্তের। তারও শক্তির একমাত্র উৎস দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে ঢুকতে না দেয়া, একাধিকবার হত্যাচেষ্টা, একুশ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেডহামলা, যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু ইত্যাদি ঘটনার কোনো কিছুই তার চলার পথকে রুদ্ধ করতে পারেনি, তাকে ভীত করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, কিন্তু স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়া তার হয়নি। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছি। বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হলেও মাথা পেতে নেবো।’ দেশপ্রেম তার সকল কাজের প্রেরণা। একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যার পক্ষেই এমনটা বলা সম্ভব। আমরা গর্বিত আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছে। আমাদের আছেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা। আমরা আরও গর্বিত, বাংলাদেশে মুজিববর্ষ চলছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন হতে চলেছে।

বঙ্গবন্ধু আজকের তরুণদের জন্য অবিসংবাদিত আদর্শ। ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। তাই বঙ্গবন্ধুই বাংলার তরুণদের সঞ্জীবনী শক্তি।

বঙ্গবন্ধু কোনো নির্দিষ্ট দলের আদর্শ নন, তিনি বাঙালির আদর্শ। তিনি নেতা, বাঙালি জাতির পিতা, স্বাধীনতার ঘোষক ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বিশ্বসভায় রাজনীতির কবি ও বিশ্ববন্ধু-কিংবদন্তি মহানায়ক। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিলো অসহায় মানুষের সেবা করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা। বর্তমানে বাংলাদেশে আদর্শ বা উদার রাজনীতির সংকট চলছে। যে তরুণরা আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা; তারা আজ রাজনীতিবিমুখ।

এখন চলছে অর্থ আর ক্ষমতার রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শের রাজনীতির কাছে বড্ড অচেনা বর্তমান রাজনীতি। আর সে জন্যই তরুণসমাজ আজ রাজনীতিবিমুখ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হার না-মানা সংগ্রামমুখর জীবন কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখার অবকাশ নেই। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামমুখর কর্মময় জীবন ও আদর্শ থেকে দেশের তরুণ সমাজকে শিক্ষা নিতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আমারসংবাদ/জেআই