Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

সংকটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল

জানুয়ারি ২৬, ২০২১, ০৬:৫৫ পিএম


সংকটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল
  • ৯ ট্রাইব্যুনালে বিচারের অপেক্ষায় ঝুলছে ২৯৩৫টি মামলা
  • চার ট্রাইব্যুনালের তিনটিতে দুই বছরে কোনো মামলাই যায়নি
  • ঢাকা জেলা মনিটরিং কমিটির সভা হয় না দেড় বছর
  • নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তি হওয়ায় আগের আদালতেই ফেরত যাচ্ছে মামলা
  • বিচারহীন ট্রাইব্যুনাল টিকিয়ে রাখা নিয়ে সংশয় প্রকাশ বিশ্লেষকদের

দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। নামে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল হলেও বিচারে ধীরগতি দৃশ্যমান। গতি হারিয়ে মামলা ঝুলছে বছরের পর বছর। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ঝিমিয়ে চলছে ট্রাইব্যুনালটি। মামলা আসছে খুবই কম, যা আসছে তার বিচারেও দীর্ঘসূত্রতা। প্রথম ১২ বছরে ঢাকার চারটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রতি বছর গড়ে ৭৩টি মামলা পাঠানো হলেও গত সাত বছরে এর সংখ্যা তলানিতে নেমে এসেছে। ট্রাইব্যুনালে সর্বসাকুল্যে মামলা এসে ঠেকেছে ১০টিতে। এদিকে গেলো দুই বছরে চারটি ট্রাইব্যুনালের তিনটিতে কোনো মামলাই যায়নি। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে ট্রাইব্যুনালগুলোর দশা আরো যাচ্ছেতাই। এমনই একটি সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। এখানে এ এম এস কিবরিয়া হত্যামামলার বিচার কাজে ১৬ বছর পার হয়েছে। গত অক্টোবরে কেবল সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। বিচারকাজ কবে শেষ হবে তা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। বিচার প্রক্রিয়া চলমান ও মামলা না এলে ট্রাইব্যুনাল টিকিয়ে রাখা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

চাঞ্চল্যকর হত্যা, ধর্ষণ, আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকদ্রব্য-সংক্রান্ত অপরাধের মামলার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০২ সালে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন পাস হয়। সেই বছরই ঢাকার প্রথম দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করে। পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি হয় আরো তিনটি ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু দুই দশকের মধ্যেই ঢাকার চার ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচারের জন্য মামলা যাওয়া থমকে গেছে। আবার বিচারিক কার্যক্রমও আটকে আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ ও সময়মতো সাক্ষী হাজির না করার কারণেই এসব মামলার কার্যক্রম আটকে গেছে। এ সম্পর্কে সরকারের মধ্যেও সচেতনতা কম। নেই তদারকিও। এদিকে চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক মামলা চিহ্নিত করে দ্রুত নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা মনিটরিং কমিটি থাকলেও তাতেও কাজের কাজ হচ্ছে না। কমিটির কাজ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গত এক বছরে ওই কমিটির সভা হয়েছে কি না, তাও জানেন না সংশ্লিষ্টরা। এদিকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনে ওই ট্রাইব্যুনালে মামলা পাঠানোর সুনির্দিষ্ট কোনো বিধানও নেই। তবে বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত লোকজন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় দুই স্তরে কমিটি আছে। জেলা মনিটরিং কমিটি ও মন্ত্রণালয়ে আছে সহিংস গুরুত্বপূর্ণ মামলা মনিটরিং কমিটি। জেলা কমিটির কাজ হলো, চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো চিহ্নিত করে তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা। কিন্তু দুই পক্ষের যোগাযোগেও আছে গাফলতি। এদিকে নিয়ম অনুযায়ী, জেলা মনিটরিং কমিটির মাসে দুবার বসার কথা থাকলেও গত দেড় বছরে ঢাকা জেলা মনিটরিং কমিটির কোনো সভাই হয়নি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ মামলার জরুরি অল্প সময়ের মধ্যে বিচার পেতে মানুষ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দ্বারস্থ হয় কিন্তু সেখানে ধীরগতিতে বিচার হলে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের গুরুত্ব থাকে না। আর ট্রাইব্যুনালে মামলা না থাকলে তা তৈরি করার যৌক্তিকতা নেই। কোন মামলা কোথায় যাবে তা সংশ্লিষ্টদের খেয়াল রাখতে হবে। আর যথাযথ নজর মনিটরিং থাকলে দ্রুত

বিচার ট্রাইব্যুনাল এভাবে মামলাহীন থাকতে পারে না। আইনজ্ঞরা বলেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতাই বিচার বিভাগের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করা হলেও সাক্ষী না আসা, প্রয়োজনের তুলনায় কম মামলা আসা ও পর্যাপ্ত ট্রাইব্যুনাল না থাকাসহ নানা কারণে এখানেও মামলা নিষ্পত্তির গতি কম। ফলে সাধারণ মানুষ আইনের প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা আরও বলেন, বিচার প্রার্থীদের জন্য দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে নজরদারি বাড়াতে হবে। ঢাকার চার ট্রাইব্যুনালের বিচারিক সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, গত বছর মামলাই গেছে একটি। সেটা ১ নম্বর ট্রাইব্যুনালে। ২০১৮ সালেও শুধু এই ট্রাইব্যুনালে মামলা পাঠানো হয়েছে পাঁচটি।

২ নম্বর ট্রাইব্যুনালে ২০১৫ সালের পর কোনো মামলা পাঠানো হয়নি। হিসাবটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনে হওয়া মামলার। এছাড়া এযাবৎকাল অন্য আইনের এক হাজার ৬৫৪টি মামলা এসব আদালতে পাঠানো হয়েছে। সেগুলোর বিচার চলছে। তবে এ প্রতিবেদনে সেগুলোর হিসাব ধরা হয়নি। এদিকে ঢাকার দ্বিতীয় ও চতুর্থ ট্রাইব্যুনালের হাতে এখন দ্রুত বিচারের জন্য কোনো মামলা নেই। এই দুটি ট্রাইব্যুনালে থাকা ১২টি মামলার বিচার উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে। অন্য দুটি ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে মাত্র ৪৫টি মামলার। আর ১৫টি মামলার বিচার উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী, ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ায় ১৩২টি মামলা অন্য আদালতে বদলি করা হয়েছে।

দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিশেষ পিপি সৈয়দ শামসুল হক বাদল বলেন, যে মামলাগুলো এখানে নিষ্পত্তির জন্য পাঠানো হয়, নির্ধারিত সময়ে তা নিষ্পত্তি হয় না। ফলে আইন অনুযায়ী কিছু মামলা আবার আগের আদালতেই ফেরত যায়। অপরদিকে সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুসারে, ৯টি ট্রাইব্যুনালে মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দুই হাজার ৯৩৫টি। এর মধ্যে গত পাঁচ বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে ২৮৮ মামলা এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আরও ৯৬ মামলা। এর মধ্যে ঢাকার চারটি ট্রাইব্যুনালে ঝুলে আছে এক হাজার ৭২৬টি মামলা। চট্টগ্রামে ৪৬, রাজশাহীতে ১৮১, খুলনায় ৩১৮, বরিশালে ৩৩৮ এবং সিলেটে নিষ্পত্তির অপেক্ষা রয়েছে ২৯টি মামলা। পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন ২৮৭টি মামলা। আর উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ৫৬টি মামলা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক অবশ্য দায়ী করছেন পুলিশ ও পিপি মিলিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সদিচ্ছার অভাবকে। তিনি  বলেন, ‘ফৌজদারি মামলা হলো রাষ্ট্র বনাম অভিযুক্ত বা আসামি। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য প্রয়োজনীয় সাক্ষী, মেডিকেল রিপোর্ট, ফরেনসিক রিপোর্ট এবং অন্যান্য প্রমাণ আদালতে হাজির করার দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রপক্ষের। রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী আনতে না পারলে আদালত বিচার শেষ করতে পারবে না।’

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন মনে করেন, এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে সরকারের মনিটরিং খুব জরুরি। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিচারক স্বল্পতা রয়েছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। একই সঙ্গে বিচার চলাকালে বারবার সমন দিয়েও সাক্ষীদের হাজির করা যায় না। সে ক্ষেত্রে বিচারক চাইলেও মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারেন না। এ জন্য এসব সমস্যা সমাধানে দ্রুত বিচারের মামলাগুলোর ওপর সরকারের মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে।’ সব মিলিয়ে আইনের সুফল পেতে হলে সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে বলেও মত তার। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে অনেক অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে যেটা দ্রুত বিচার হওয়া জরুরি। তাই দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালকে আরো গতিশীল করতে সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বসহকারে কাজ করতে হবে।’

দ্রুত বিচারেও ১৬ বছর পার : ২০০৫ থেকে ২০২১ সাল। মাঝখানে কেটে গেছে ১৬টি বছর। সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার বিচারকার্যে এই দীর্ঘ সময় গত হয়েছে সিলেট ও হবিগঞ্জের আদালতে। তৎকালীন সময়ে মামলাটি হস্তান্তর করা হয় সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ৯০ কার্যদিবসে মামলা নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও ৩২১ ধার্য তারিখেও নিষ্পত্তি হয়নি বিচারকাজ। এই সময়ে মামলার ১৭১ সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে মাত্র ৪৩ জনের। আলোচিত এই মামলাটি কবে নাগাদ নিষ্পত্তি হতে পারে তা-ও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না মামলার বাদি ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরাও। মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা প্রায় পৌনে দুইশ। ৪৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। এ ছাড়া আসামিদের অনিয়মিত হাজিরার কারণে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এই মামলার বিচারকার্য বিলম্বিত হচ্ছে। গত ২২ অক্টোবর ওই ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলায় আদালতে অভিযোগ (চার্জ গঠন) গঠন করা হয়েছে।

সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহারিয়ার কবিরের আদালতে এসব মামলার অভিযোগ গঠন করেন।

এরই মধ্যে সিলেটের আদালতেই ছয় বিচারকের হাত বদল হয়েছে মামলাটি। বর্তমানে সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক রেজাউল করিমের আদালতে মামলাটির বিচার কার্য চলছে। এর আগে সিলেট জেলা ও দায়রা জজ মমিনুল্লাহ, মনির আহমদ পাটোয়ারী, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিপ্লব গোস্বামী, দিলীপ কুমার দেবনাথ, মকবুল আহসানের আদালতে গিয়েছিল মামলাটি।

আমারসংবাদ/জেআই