Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

শিকলে বাঁধা সাহিদার জীবন

সজিব গুহ মজুমদার, হরিরামপুর (মানিকগঞ্জ)

জানুয়ারি ২৬, ২০২১, ০৮:৪০ পিএম


শিকলে বাঁধা সাহিদার জীবন

পায়ে শিকল বাঁধা। শিকলবন্দি অবস্থায়ই কাটে তার দিন-রাত। খাবার খাওয়া, গোসল, ঘুম সবই হয় শিকলবন্দি অবস্থায়। এমনকি টয়লেটের কাজও। ঘরের বারান্দার একপাশের ছোট একটি কক্ষেই কাটছে তার জীবন। এভাবেই কেটে গেছে তার এক যুগ। শিকলবন্দি এ নারীর নাম সাহিদা বেগম (৪৮)। তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার গালা ইউপির গালা গ্রামের দিনমজুর আমেরুদ্দিন মোল্লার (৫৮) স্ত্রী সাহিদা বেগম। গত সোমবার তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেমিপাকা চারচালা টিনের ঘরের বারান্দার একপাশের ছোট্ট একটি কক্ষে চৌকির উপর শিকলবন্দি অবস্থায় বসে আছেন সাহিদা বেগম। কক্ষে আছে একটি চৌকি ও একটি চেয়ার। চৌকির ওপর লেপ মুড়ি দিয়ে জড়সড় হয়ে বসেছিলেন তিনি। লেপের কিছু জায়গায় ছিঁড়ে গিয়ে তুলা বেরিয়ে পড়েছে। তার পরনে ছিলো ময়লা একটা শাড়ি। কক্ষ থেকে বের হওয়ার জন্য কোনো দরজা দেয়া হয়নি, জানালার সমান করে জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে। সেখান দিয়ে বের হয়েই তাকে টয়লেটের কাজ সারতে হয়। সাহিদা বেগমের সুবিধার্থে টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে বারান্দার প্রায় সাথেই। খাবারের সময় হলে বারান্দার কক্ষের সামনে চেয়ারে খাবার রেখে দেন তার স্বামী। সেখান থেকে নিয়েই খাবার খান তিনি। অনেক সময় তাকে খাইয়েও দিতে হয়।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১৫ বছর আগে হঠাৎ করেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিন সন্তানের জননী সাহিদা বেগম। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় ডাক্তার-কবিরাজ-ফকির দিয়ে চিকিৎসা করালেও তাতে ফল হয়নি। দিনে দিনে সমস্যা বাড়তে থাকায় পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে ৩৫ হাজার টাকার চুক্তি হয়। কথা ছিলো সাহিদা বেগমকে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ করে দেবে। এক মাস ১৩ দিন পর ব্যবস্থাপত্র লিখে হাসপাতাল থেকে তাকে রিলিজ দেয়া হয়। এরপর দীর্ঘদিন ওই ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খাওয়ালেও অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। এরপরও বিভিন্ন ডাক্তার ও ফকির দিয়ে চিকিৎসা করালেও কোনো লাভ হয়নি। আর্থিক অনটনের কারণে প্রায় তিন বছর যাবত চিকিৎসা-ওষুধ বন্ধ রয়েছে তার। সাহিদা বেগমের দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। বড় ছেলে স্বপন মোল্লা জেলা সদরের একটি রেস্টুরেন্টে বাবুর্চির কাজ করেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ওখানেই বাসা ভাড়া থাকেন তিনি। ছোট ছেলে সোহেল মোল্লা ঢাকায় ছাপাখানায় চাকরি করে। তার স্ত্রী-সন্তান বাড়িতে থাকলেও বাবা-মায়ের কোনো খোঁজ খবর রাখে না। ফলে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন আমেরুদ্দিন মোল্লা। স্ত্রীর বিষয়ে কথা হলে আমেরুদ্দিন মোল্লা (৫৮) জানান, স্ত্রীর মানসিক অসুস্থতার কারণে প্রায় ১৫ বছর যাবত তার সংসারটি এলোমেলো। দিনমজুরের কাজ করে সাধ্যমতো টাকা খরচ করে চিকিৎসা করিয়েও কোনো উপকার হয়নি। তার কোনো জমিজমা নেই। অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে দিনমজুরির কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে খাওয়া খরচ চালিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই বর্তমানে সাহিদা বেগমের চিকিৎসা-ওষুধ বন্ধ রয়েছে। মানসিক ভারসাম্যহীন সাহিদা বেগম বিভিন্ন সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন। অনেকবার খুঁজে তাকে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। এরপর থেকেই শিকলে বেঁধে রাখতে হয়েছে তাকে। নইলে কখন কোনদিকে চলে যান, কিংবা গাড়ির নিচে পড়েন।

সাহিদা বেগমের স্বামী আরও বলেন, ‘দুই ছেলে বিয়ে করে তারা-তাদের মতো আলাদা খায়। আমাগো কোনো খোঁজ খবর রাখে না। আমাকে ঘরে-বাইরে সব জায়গাই দেখতে হয়। নিজেই রান্নাবান্না করি। স্ত্রীকে দেখাশোনা করি। আবার মানুষের বাড়ি কামলাও দিতে হয়। সাহিদা বেগমের ভাবী বিলকিস জানান, অসুস্থতার আগে বেশ ভালো মানুষ ছিলেন সাহিদা বেগম। মানুষের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করতেন। সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতেন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আজ তার এই করুণ পরিস্থিতি। গালা ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ড সদস্য শেখ বারেক জানান, সাহিদা বেগমের মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই পরিবারটি অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছে। মূলত সঠিক চিকিৎসার অভাবেই এখনো এই অবস্থায় রয়েছে। রোগীর যে অবস্থা তাতে সঠিক চিকিৎসা করতে পারলে হয়তো ভালো হতো। আমি ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে তাদের ত্রাণ সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করি। হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সাহিদা বেগমের চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে সহযোগিতা পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করবো।’

আমারসংবাদ/জেআই