Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

ডাক্তাররা হাসপাতালে আসেন হাজিরা দিতে

আদালত প্রতিবেদক

ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২১, ০৮:১০ পিএম


ডাক্তাররা হাসপাতালে আসেন হাজিরা দিতে

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জনসহ চিকিৎসকদের উদ্দেশে আদালত বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষের জীবন হাসপাতালের ক্লার্ক, পিয়নের হাতে ছেড়ে দিয়ে আপনারা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নেমে পড়েছেন। হাসপাতালে আসেন শুধু হাজিরা দেয়ার জন্য। তারপর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এভাবে চলতে পারে না।’ গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

ভুক্তভোগী শিশুর তিনটি মেডিকেল রিপোর্ট ও একটি ছাড়পত্রে অসঙ্গতি নিয়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘আপনারা একেক রিপোর্টে একেক তথ্য দিয়েছেন। ভাষাও বোঝা যায় না। সাধারণ মানুষ যেনো বোঝে এমন ভাষায় রিপোর্ট লিখতে হবে।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসপিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘পুলিশকে বলা হয় জনগণের বন্ধু। আমরা আপনাদের কাজকর্মে সেটাই দেখতে চাই। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে শিশু ধর্ষণের এক ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশুর তিনটি মেডিকেল রিপোর্ট ও একটি ছাড়পত্রে অসঙ্গতির ঘটনায় দোষ স্বীকার করে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্ট আট চিকিৎসক। চিকিৎসকরা বলেন, ‘ভবিষ্যতে ভুল হবে না এবং দায়িত্ব পালনে সতর্ক থাকবেন।’

এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসপিসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তা আদালতে বলেন, ‘আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আদালতের আদেশ আমরা মেনে চলবো।’ শুনানি শেষে আদালত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন, এসপিসহ ১১ জনকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে আপাতত অব্যাহতি দেন। আদালতে আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুটির পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. শাহ পরান চৌধুরী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মনিরুল ইসলাম। এর আগে সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশুর তিনটি মেডিকেল রিপোর্ট ও একটি ছাড়পত্রে অসামঞ্জস্যতার ব্যাখ্যা দিতে হাইকোর্টে হাজির হন জেলাটির সিভিল সার্জন, পুলিশ সুপারসহ ১১ কর্মকর্তা। এরা হলেন— সিভিল সার্জন ডা. একরাম উল্লাহ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিছুর রহমান, নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এটিএম আরিফুল হক, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. একরামুল রেজা, ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য ডা. ফাহমিদা আক্তার, ডা. তোফায়েল হক, ডা. ফরিদা ইয়াসমিন, নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. সৈয়দ মো. শাহরিয়ার, ডা. তাসনিম তামান্না, ডা. মো. শফিকুল ইসলাম।

গত ১৭ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী ওই শিশুর তিনটি মেডিকেল রিপোর্ট ও একটি ছাড়পত্রে অসামঞ্জস্যতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন, পুলিশ সুপারসহ ১১ জনকে তলব করেন আদালত। একই সঙ্গে ওই ঘটনায় দুটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া রুল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় এ ঘটনায় নাসিরনগর থানায় করা মামলা তিন মাসের জন্য স্থগিত এবং আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু ও তার পরিবারের সদস্যদের কোনো রকম হয়রানি করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন আদালত। আদালত এ মামলায় ভুক্তভোগীর (শিশুর) ডাক্তারি পরীক্ষায় কোনো অনিয়ম, অবহেলা বা গাফিলতি হয়েছে কি-না তা উদঘাটনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশিষ্ট কমিটিকে এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি, মামলাটি তদন্তের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম, অবহেলা বা গাফিলতি হয়েছে কি-না তা উদঘাটনের জন্য পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে একমাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

মামলার বিবরণে জানা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে দেয়া ছাড়পত্রে বলা হয়েছে, ৩ সেপ্টেম্বর শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়। সেখান থেকে দেয়া আরেক রিপোর্টে বলা হয়, শিশুটির বাহ্যিক কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে সদর হাসপাতালের মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। তাদেরই আরেকটি তথ্য বলছে, জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন হয়েছে। এজাহার ও নথিপত্র পর্যালোচনা করে আদালত বলেছেন, গত ৪ সেপ্টেম্বর ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর ৬ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভুক্তভোগী শিশুটি নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলো। চার সদস্যের চিকিৎসকের মেডিকেল বোর্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যৌন নির্যাতন হয়েছে, বিষয়টি প্রশ্নবোধক। নথিপত্র থেকে জানা যায়, গত ৯ সেপ্টেম্বর বেলা তিনটায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিশু (৭) ধর্ষণের শিকার হয়। প্রথমে শিশুটিকে নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশুটির বাবা গত ১১ সেপ্টেম্বর নাসিরনগর থানায় এক শিশুর (১২) বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় শিশুটি হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত নভেম্বর শিশুটিকে আট সপ্তাহের আগাম জামিন দেন। একই সঙ্গে তদন্ত কাজ শেষে একমাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলার সিডি (কেস ডকেট) আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এসবের ওপর শুনানি নিয়ে এ আদেশ দেয়া হয়।

আমারসংবাদ/জেআই