Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

বরিশালের সব প্রকল্পেই ধীরগতি

জাহাঙ্গীর আলম

ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২১, ০৮:৪৫ পিএম


বরিশালের সব প্রকল্পেই ধীরগতি
  • ২০১৬ সালে পায়রা সেতু শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ
  • সময় শেষ হয়ে এলেও পায়রা সমুদ্রবন্দরের অগ্রগতি মাত্র ৮.৫৯ শতাংশ
  • অনেক প্রকল্প পরিচালক এলাকায় না থেকে বিভিন্ন ছুতায় থাকেন ঢাকায়

সারা দেশের উন্নয়নে সরকার চলতি অর্থবছরে প্রায় দুই লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এতে এক হাজার ৭২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। ছয় মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের ৬৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সাত হাজার কোটি টাকার বেশি বা মোট এডিপির ৩.৩১ শতাংশ। কিন্তু কাজের অগ্রগতি অনেক কম। ২২.৬১ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে ছয়টি প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য।

যেখানে কোনো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে জুনে। পায়রা সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনালসহ ১৩টি প্রকল্পের অগ্রগতি ২৫ শতাংশ। ৫০ শতাংশ ১৯টি এবং ৫১-এর বেশি ২৯টি প্রকল্প রয়েছে। পাঁচতলা বরিশাল সরকারি বিএম কলেজের উন্নয়নকাজ বাহ্যিক দৃষ্টিতে ভবনের কাজটি ভালো মনে হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গেছে। বাথরুমের টয়লেটগুলো সঠিকভাবে স্থাপন করা হয়নি। বারান্দার কাজ অসম্পূর্ণ। এভাবে বিভিন্ন কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। ছোটখাটো ত্রুটি রয়েছে। পায়রা সেতু নির্মাণ, পায়রা সমুদ্রবন্দর, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনসহ অসংখ্য প্রকল্পে ধীরগতি, কোনো পিডি প্রকল্প এলাকায় না থেকে বিভিন্ন ছুতায় ঢাকায় থাকেন। আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। 

বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মোট অগ্রগতি হয়েছে ২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। সরকার বরিশাল বিভাগের উন্নয়নে সাত হাজার ১০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। তাতে ৬৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু ছয় মাসে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২২ দশমিক ৬১ শতাংশ। এর মধ্যে ছয়টি প্রকল্পের অগ্রগতি একেবারে শূন্য। প্রকল্পগুলো হচ্ছে ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে বরিশাল-ভোলা-লক্ষ্মীপুর জাতীয় মহাসড়কের বরিশাল থেকে ভোলা হয়ে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত যথাযথ মান ও প্রশস্ততকরণ প্রকল্প। এটি ২০১৯ সালের মার্চে শুরু হয়ে ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। শূন্যের কোটায় রয়েছে ৮৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ভোলা-চরফ্যাসন আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। ২০২০ সালে শুরু হয়ে ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা। প্রায় ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সুগন্ধা নদীর ভাঙন থেকে বীরশ্রেষ্ঠ কাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু রক্ষার্থে স্থায়ী রক্ষাপ্রদ কাজ প্রকল্প। ২০২০ সালের মার্চে শুরু হয়ে ২০২৫ সালে শেষ হওয়ার কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার বরিশাল স্থাপন প্রকল্প। ৪২২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০২০ সালে শুরু হয়ে ২০২২ সালে শেষ হবে। এ ছাড়া পিরোজপুর জেলার নেসারাবাদ উপজেলা হেডকোয়ার্টার থেকে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া ভায়া নজিরপুর রাস্তা ও সেতু নির্মাণকাজের সমীক্ষা প্রকল্প। প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গত বছরে শেষ করার কথা থাকলেও অগ্রগতি শূন্য। একই সাথে দীর্ঘ সময়ে ১৩টি প্রকল্প মাত্র ২৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পায়রা সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে। প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। যেখানে ২০১৯ সালে শুরু হয়ে ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

প্রধান প্রধান কাজ হচ্ছে— আন্দারমালিক নদীর ওপর এক হাজার ১৮০ মিটার সেতু নির্মাণ, ৬.৩৫ কিলোমিটার ছয় লেনের সংযোগ সড়ক। জেটি নির্মাণ ৪৬ হাজার ২০০ বর্গমিটার। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক লাইন, অপটিক্যাল ফাইবার লাইন নির্মাণও রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করা হলেও প্রকল্প পরিচালক উপ-প্রধান প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিনসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা বেশির ভাগ সময় ঢাকায় কাটান। তার মতামত জানতে যোগাযোগ করা হলেও ফোন না ধরায় মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।  

প্রায় দেড় হাজার মিটার দীর্ঘ পটুয়াখালী মহাসড়কে পায়রা নদীর ওপর পায়রা সেতু (লেবুখালী সেতু) প্রকল্পটি ২০১৬ সালে সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। তা পরিদর্শন করা হয়। এর কারণ হিসেবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে বিলম্ব, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নিয়োগে তিন বছর আট মাস বিলম্ব এবং মূল সেতুর ডিজাইন ও নদীতীর রক্ষাপ্রদ কাজের ডিজাইনে অতিরিক্ত ১৪ মাস ব্যয় চলে গেছে। প্রকল্পটির মূল প্রাক্কলিত ব্যয় ছিলো ৪১৩.২৯ কোটি টাকা। এরপর প্রকল্পটি দুইবার সংশোধন করে এর প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৪৪৭.২৪ কোটি টাকা।  দুইবার সংশোধন করে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে এক হাজার ৩৩.৯৫ কোটি টাকা (২৫০.১৮ শতাংশ)। সময় বাড়ানো হয়েছে ৬৬ মাস (১১৬ শতাংশ)। ২০২২ সালে শেষ হবে এ প্রকল্প।

সচিবের নেতৃত্বে ২৩ জানুয়ারি পায়রা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র সংযোগ সড়ক ও আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পটি পরিদর্শন করা হয়। ২০১৮ সালের জুলাই শুরু হয়ে ২০২১ জুনে শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (নওপাজেকো)। ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৩১ শতাংশ।  তাই আগামী জুনে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও কিন্তু তা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে প্রস্তাব করা হয়েছে। একই দিনে পটুয়াখালী এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি উন্নয়ন এবং পুনর্বাসন প্রকল্পটিও পরিদর্শন করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে রোর্যাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল)। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ৮৭০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৭৫ শতাংশ। ভূমি উন্নয়নে দূরবর্তী স্থান থেকে বালু উত্তোলনের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বেশি লাগছে। পটুয়াখালী এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি উন্নয়ন ও সংরক্ষণ প্রকল্পটিও মনিটরিং করা হয়। এটি ২০১৮ সালে শুরু হয়ে ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা।

প্রায় ৮২০ কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে এই প্রকল্পের মূল কাজের মধ্যে তিন কিলোমিটার সিসি ব্লক দিয়ে ভূমি সংরক্ষণ ঢাল নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য কাজ ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে সমাপ্ত করা যায়নি। এ পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ২৬.৮৬ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ২৪.২৯ শতাংশ। তাই  নির্ধারিত সময়ে সম্পূর্ণ কাজ শেষ করা যাবে না। আরও এক বছর প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির করা হতে পারে।

এছাড়া পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন শীর্ষক প্রকল্প পরিদর্শন করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত বিভাগ। ৫৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালে একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এখনো অনেক কাজ বাকি। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে— চিকিৎসা শিক্ষার জন্য অবকাঠামো স্থাপন; পটুয়াখালী ও পার্শ্ববর্তী জেলার জনগণের জন্য চিকিৎসা সুবিধা প্রদান এবং কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আইএমইডি থেকে প্রকল্পটি পরিদর্শন করে  দ্রুত সমাধানের জন্য সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। প্রকল্পটিতে অধিক সংখ্যক ঠিকাদার কাজ করছে। তাই গুণগত মান নিশ্চিত করে দ্রুত প্রকল্পটির কাজ শেষ করতে মন্ত্রণালয়সহ প্রকল্প দপ্তরের আরও নিবিড় তদারকি প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

পটুয়াখালী জেলায় নির্মাণাধীন ফায়ার সার্ভিস স্টেশনটিও পরিদর্শন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত বিভাগ, প্রকল্পটির প্রাক্কলিত মূল্য পাঁচ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে ২০১৯ সালের ১৯ জুন চুক্তি সই হলেও প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ২৬ শতাংশ। যা মোটেই সন্তোষজনক নয়। ঠিকাদার কাজের ধীরগতির ব্যাপারে কোনো যৌক্তিক জবাব দিতে পারেননি, এটা দুঃখজনক। এতে সরকারি কাজেরও ক্ষতি হচ্ছে। এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুন পর্যন্ত।

কাজের মান ও গতি বাড়াতে সুপারিশ : সচিবের নেতৃত্বে কমিটি ২০ থেকে ২৫ জানুয়ারি বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করে কাজের ধীরগতি ও ত্রুতি-বিচ্যুতি পেয়ে মান ও গতি বাড়াতে কিছু সুপারিশও করেছে। এর মধ্যে হচ্ছে— উন্নয়নমূলক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকদের প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করে সার্বক্ষণিক তদারকি করতে হবে। সকল বিভাগের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা এবং অগ্রগতির বিষয়ে জেলা প্রশাসককে তালিকা দিতে হবে। জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে কাজ এগিয়ে নিতে হবে।

আমারসংবাদ/জেআই