Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

শুরু আছে শেষ নেই!

মার্চ ২, ২০২১, ০৮:০০ পিএম


শুরু আছে শেষ নেই!
  • বাদি-বিবাদিদের চেয়ে বড় স্বার্থ আইনজীবীদের
  • মামলার পেছনে অর্থ ঢেলে নিঃস্ব হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা
  • মামলা কেন হয়, খুঁজে বের করে ওই কারণগুলো কমাতে হবে -অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ
  • ঘন ঘন শুনানি মুলতবির আবেদন ও মঞ্জুর ন্যায়বিচারের অন্তরায় -ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ
  • দেওয়ানি আইন পরিবর্তন ছাড়া মামলাজট কমানো সম্ভব নয় -অ্যাটর্নি জেনারেল

সরকারি চাকরিজীবী ইমামুল হক ও তার ভাই একরামুল ১৯৯৪ সালে যৌথভাবে ২৯ শতাংশ ডোবা জমি কিনেছিলেন (দলিল নং-৭৪৩৪)। ঢাকা জেলার সোনারগাঁও থানাধীন কাঁচপুর মৌজায় অবস্থিত ওই জমির সিএস ও এসএ রেকর্ড হালনাগাদ করে ভোগদখল করছিলেন। দীর্ঘদিনই ওই জমিতে মাছ চাষ চলছিল। বিপত্তি ঘটে ২০০৯ সালে খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে।

তখন ইমামুল  জানতে পারেন সাফ-কবলায় কেনা জমি মালিকানাস্বত্বহীন অচেনা চার ব্যক্তির নামে আরএস রেকর্ড ও মিউটেশন হয়ে গেছে। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে দুই ভাইয়ের। প্রতিকার চাইতে ‘ভুল’ সংশোধনীর আবেদন নিয়ে যান এসিল্যান্ড অফিসে। বিপত্তি সেই থেকেই শুরু। এসিল্যান্ড কার্যালয় তাদের পক্ষেই আদেশ দেন। তবে আদেশে জুড়ে দেন ছোট্ট একটি বাক্য। যেই বাক্যে আটকে আছে দীর্ঘ ২৭ বছরের আক্ষেপ। ওই আদেশে বলা হয়— রেকর্ড সংশোধনীর জন্য যেতে হবে আদালতে। সেই থেকেই শুরু হয় দোড়ঝাঁপ। সিএস এবং এসএ রেকর্ডের ভিত্তিতে ২০১০ সালে মামলা (২৬/২০১০) করেন ইমামুল হক। বিবাদিদের পক্ষে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসেন আরেক আগন্তুক স্থানীয় নজরুল ইসলাম খান নামের এক ব্যক্তি। মামলায় তারিখের পর তারিখ পড়ে। বিচারক বদল হয়। ২৩টি কার্যদিবস অতিবাহিত হলেও বিবাদিপক্ষ সাড়া দেয়নি। একপর্যায়ে আদালত একতরফাভাবে শুনানির আদেশ দেন। এ সময় প্রায় দুই বছর পর হাজির হয় বিবাদিপক্ষ। অর্থদণ্ড পরিশোধ সাপেক্ষে তারা আবেদন জানান আদেশ প্রত্যাহারের।

আদালত বিবাদিদের কাছ থেকে তাদের নামে আরএস রেকর্ডভুক্ত করে নেয়ার পক্ষে দলিলাদি চান। তবে তারা সেটা দেখাতে পারেনি। ফলে বিবাদিদের আদালতে অনুপস্থিতিতে আদালত ২০১৫ সালের ২১ জুন একতরফাভাবে ইমামুল হকের পক্ষে রায় দেন। এ রায়ের ৯ মাস পর মুলতবি আইনের আওতায় ছানি মামলা (নং-০৩/১৬) করেন বিবাদিপক্ষ। ছানি মামলা চলে আরও পাঁচ বছর। ২০২০ সালে বিবাদি নজরুলের ছানি মামলার আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত। এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন ইমামুল হক। বিবাদিদের আবেদন মঞ্জুর আদেশ এবং আদালত পরিবর্তন চেয়ে ইমামুল আপিল করতে গেলে আপিলীয় আদালত ‘মামলাটি শেষ পর্যায়ে রয়েছে’ উল্লেখ করে পূর্ব আদালতেই ফেরত পাঠান। সেই থেকে ২৭ বছর এক আদালত থেকে অন্য আদালতে ঘুরছে মামলাটি। ইমামুল হক এখন আপিল শুনানির জন্যই আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন এক বছর ধরে।

দেশের বিচার ব্যবস্থাপনার প্রতি হতাশ অবসরে যাওয়া ইমামুল হক আক্ষেপ করে বলেন, ‘এই হলো আমাদের বিচারব্যবস্থা। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি ১১ বছর আগে। এখনো থাকছি ভাড়া বাসায়। জামানো সঞ্চয় দিয়ে দু’ভাই মিলে একখণ্ড জমি কিনেছিলাম। মামলার দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ে সেটি ভোগদখল আর হলো না। এসিল্যান্ডের একটি বেআইনি আদেশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে দেওয়ানি মামলা (নং-২২৮/২০১৪)। সেটি নিষ্পত্তির উদ্যোগ থেকে সৃষ্টি হয় ছানি মামলা (নং-০৩/১৬)। মামলার বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছতে লেগেছে প্রায় ১২ বছর। আদালতের কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে ৯৮টি। বিচারক আসেন-বিচারক বদলি হয়ে যান। আমার মামলার কিনারা হয় না।’

শুধু ইমামুল ও একরামুলই নয়, দেশে জমির মামলা হলেই যেত শেষ নেই। মামলা চলে বংশ পরাম্পরায় তবুও নিষ্পত্তি হয় না। মামলা করেন দাদা, সেই মামলা বাপ পেরিয়ে রায় হাতে পান নাতি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলতে থাকে আইনি লড়াই। লড়াই আর শেষ হয় না। শেষ হওয়ার উপক্রম হলেও লড়াই বাঁচিয়ে রাখা হয়। কারণ এখানে রয়েছে নানামুখী স্বার্থ। বাদি-বিবাদিদের চেয়ে বড় স্বার্থ আইনজীবী, আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। মামলা করে কোনো বাদি ১০ বছরের মধ্যে ফলাফল পেয়েছেন— এমন দৃষ্টান্ত কম। যে সম্পত্তির জন্য মামলা— সেই সম্পত্তির মূল্য আর মামলার পেছনে ব্যয়িত অর্থ অনেক সময় সম্পত্তির মোট মূল্যকেও ছাড়িয়ে যায়।

এদিকে জমির মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতার আলোকে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, মামলার আরজি প্রস্তুত, শুনানির জন্য নোটিস জারি, বিবাদির জবাব দাখিল ও গ্রহণে বিলম্ব, ঘন ঘন শুনানি মুলতবির আবেদন ও তা মঞ্জুর, বিচারক ও এজলাস স্বল্পতা, জুডিশিয়াল পলিসি ও দেওয়ানি আইনের সংস্কার না হওয়াসহ নানা জটিলতায় দেওয়ানি মামলার নিষ্পত্তি হয় ধীরলয়ে। এতে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশ সৃষ্টির শুরু থেকেই জমির মামলার সময়মতো নিষ্পত্তির কোনো নজির নেই। সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টদের আগ্রহও লক্ষ করা যায়নি। আদালতে তারিখের পর তারিখ পড়ে। বিচারক বদল হন। এক মামলা থেকে সৃষ্টি হয় আরেক মামলা। সব মামলায় বাদি-বিবাদি হাজিরা দেন। মামলার পেছনে অর্থ ঢেলে নিঃস্ব হন বিচারপ্রার্থী। মূলত দেওয়ানি মামলায় বাদি কিংবা বিবাদি— কেউই জেতেন না। জয়ী হন আইনজীবী, মহুরি আর আদালত সহায়ক কর্মচারীরা। মক্কেলের টাকায় তাদের পকেট ভরে। জমি-জিরাত বিক্রি করে মক্কেল নিঃস্ব হন। গাড়ি-বাড়ির মালিক হন আদালত সংশ্লিষ্টরা।

আইনজ্ঞরা বলছেন, একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি মামলা পরিচালনার অনুপযোগী। এ আইনের প্রয়োগ পদ্ধতিও আধুনিক নয়। দেওয়ানি মামলার দীর্ঘসূত্রিতা লাঘবে প্রথমই প্রয়োজন আইনের সংস্কার। সুপ্রিম কোর্ট দপ্তর সূত্র জানায়, দেশের আদালতগুলোতে বিভিন্ন পর্যায়ে অন্তত ১৫ লাখ দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে আপিল বিভাগে রয়েছে সাড়ে ১৫ হাজার দেওয়ানি মামলা। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন অন্তত এক লাখ মামলা। শুধু ঢাকা জেলার বিভিন্ন দেওয়ানি আদালতে এক লাখ ১৩ হাজার মামলা বিচারাধীন। বেশির ভাগ মামলাই জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ সংক্রান্ত। এর মধ্যে জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন প্রায় ৯৭ হাজার মামলা। প্রতিদিনই এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন মামলা। কিন্তু এ মামলা জট কিভাবে নিরসন হবে-যুতসই কোনো জবাব নেই কারো কাছেই। জট থেকে সমাধানের উপায় কী— এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আসলে মামলার জট আদালতে নিষ্পত্তির ধীরগতির কারণে হয় না। এর জন্য দায়ী মামলার কারণ। মামলার কারণ উদ্ভাবনের জন্যই আদালতে মামলা আসে। আদালতে চাপ বাড়ে। নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মামলা কেন হয়, এর কারণ খুঁজে বের করে ওই কারণগুলো কমাতে হবে। প্রশাসন থেকে শুরু করে পুলিশ সবাই যদি তাদের দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করে তাহলে মামলার কারণ ও মামলার চাপ কমবে।’

দিন, মাস, বছর, যুগ-যুগান্তর পার হয়ে যায়— দেওয়ানি মামলার নিষ্পত্তি হয় না। কেন নিষ্পত্তি হচ্ছে না— এ প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘মানুষ সংবিধান অনুযায়ী দ্রুত ন্যায়বিচার পাচ্ছে কি-না তার ওপর নির্ভর করে দেশের উন্নয়ন। আমরা সবসময়ই বলে আসছি, যেভাবে এবং যে পদ্ধতিতে বিচারব্যবস্থা চলছে তা দিয়ে এ বিশাল মামলাজট নিরসন ও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘব হবে না। বিচারকালীন ঘন ঘন শুনানি মুলতবির আবেদন ও তা মঞ্জুর বিচারের অন্তরায়। একবার শুনানি শুরু হলে কোনো মুলতবি ছাড়াই মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘব হতে পারে।

দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তিতে গতিশীলতা আনতে অ্যাটর্নি অফিস কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি-না এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন  বলেন, ‘দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া আসলে সম্ভব হয় না। দেওয়ানি মামলার বিষয়টা তো আর আমি দেখতে পারবো না। এটা আইন যেভাবে আছে সেভাবেই চলবে। এটা আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়, এটা নিয়ে আমাদের করার কিছু থাকে না। আর মূলত দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে কোর্টেরও কিছু করার থাকে না। এটা নিষ্পত্তি বা সমাধানের জন্য বাদি-বিবাদি উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে। তারা যদি আদালতকে সহযোগিতা না করেন তাহলে জটিলতা থেকেই যায় আর নিষ্পত্তিতেও ঝামেলা হয়।’  দেওয়ানি মামলার বিচারকাজ গতিশীল করতে উচ্চ আদালতে বেঞ্চ বাড়ানো হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য উচ্চ আদালতে কোনো বেঞ্চ ঘাটতি নেই, আগে থেকেই পর্যাপ্ত বেঞ্চ সৃষ্টি করা হয়েছে। জমির মামলাজট কমাতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই আইন কর্মকর্তা পরামর্শ দিয়ে বলেন, আসলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেওয়ানি আইনের কিছুটা পরিবর্তন আনা উচিত বলে মনে করি। আর এটা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। কারণ শত বছরের পুরনো এই আইন পরিবর্তন করা ছাড়া এসব মামলাজট কমানো সম্ভব নয়। তাই সংশ্লিষ্টদের দ্রুত এ আইনের সংশোধন করা উচিত। 

আমারসংবাদ/জেআই