Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

বাড়ছে মজুদ কমছে আগ্রহ

মাহমুদুল হাসান

মার্চ ৫, ২০২১, ০৮:১০ পিএম


বাড়ছে মজুদ কমছে আগ্রহ
  • প্রান্তিকে টিকাদান কেন্দ্র দূরে হওয়ায় অনেকে রেজিস্ট্রেশন করেও টিকা নিতে আসছেন না -অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
  • টিকাদান কেন্দ্র যদি বাড়ানো যায় তাহলে প্রান্তিক মানুষজনকে আরও বেশি যুক্ত করা যাবে -ডা. মো. মুশতাক হোসেন, সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আইইডিসিআর

প্রায় এক মাস হলো গণটিকাদানের। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী, অনেক মন্ত্রী, সাংসদ ও আমলারা টিকা নিয়েছেন। টিকাগ্রহীতাদের মধ্যে সাধারণ মানুষও নেহায়েত কম নয়। বাদ পড়েনি টিকার সমালোচনাকারীরাও। বিশ্বের ৫৪তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ গত সাত ফেব্রুয়ারি বিনামূল্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকা প্রয়োগ করছে। সেরামের সঙ্গে সরকার তিন লাখ ডোজ টিকা ক্রয়ের চুক্তি করেছে। ইতোমধ্যে সেখান থেকে ৭০ লাখ ডোজ টিকা এসেছে। এর বাইরে ভারত সরকার উপহার হিসেবে আরও ২০ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে ৯০ লাখ ডোজ টিকা এসেছে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪৭ লাখ ৭০ হাজার ৯৫৩ জন মানুষ টিকার জন্য সুরক্ষা ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। এখানেই শেষ নয়! সরকার গর্ভবতী নারী ও ১৮ বছরের কম বয়সি ছাড়া দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে চাইছে। এ জন্য সেরামের সঙ্গে আরও তিন কোটি ডোজ টিকা ক্রয়ের বিষয়ে আলোচনা চলছে। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স প্রকল্প থেকে এক কোটি ৯ লাখ আট হাজার ডোজ টিকা আসছে বলে জানানো হয়েছে। এ ছাড়াও জনসন অ্যান্ড জনসনের এক ডোজের টিকা সংগ্রহরে বিষয়েও আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা টিকাদান বিষয় পরিকল্পনায় দেখা গেছে, টিকা সংগ্রহ ও প্রয়োগে সরকার বেশ আগ্রহী। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে টিকা গ্রহণে বেশ অনাগ্রহ দেখা গেছে। গত বৃহস্পতিবার এক লাখ ২১ হাজারের কিছু বেশ মানুষ টিকা নিয়েছেন। অন্যদিকে মাত্র দুই সপ্তাহ আগে এর প্রায় দ্বিগুণের বেশি মানুষ টিকা গ্রহণ করেছেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীসহ সারা দেশের দুই লাখ ৬১ হাজার ৯৪৫ জন মানুষ টিকা নিয়েছেন। যা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ টিকা গ্রহণের রেকর্ড। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় দেড় লাখ মানুষের টিকায় আগ্রহের পরিমাণ কমেছে। এ পর্যন্ত ৩৫ লাখ ৮১ হাজার ১৬৯ জন মানুষ টিকা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮০৭ জনের শরীরে মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের টিকাদান কেন্দ্রগুলো নগরীতে হাতের নাগালে হলেও প্রান্তিকে এখনো অনেক দূরে। একটি উপজেলায় একাধিক ইউনিয়ন পরিষদ থাকলেও উপজেলা সদরে মাত্র একটি টিকাদান কেন্দ্র। এতে করে প্রান্তিক মানুষ একটি কর্মদিবস নষ্ট করে অর্থ ব্যয় করে টিকা নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রান্তিক মানুষের হাতের নাগালে টিকাদান কার্যক্রম পৌঁছোতে পারলে আরও বেশি মানুষ যুক্ত করা যাবে। দেশের টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও এসব বাস্তবতা স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, করোনা ভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম সম্প্রসারণে সরকার খুবই ইতিবাচক। ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচি সম্প্রসারণের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সেই সাথে স্পট রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হওয়ায় টিকাগ্রহীতার সংখ্যা কমছে বলেও তারা জানিয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীসহ সারা দেশের এক হাজার সাতটি সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে করোনা ভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি চলছে। এসব কেন্দ্রের দুই হাজার ৫০০টি বুথে প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক দিকাদান কাজ পরিচালনা করছে। গত সাত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই টিকাদান কার্যক্রম প্রতিদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত চলছে। তবে শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সর্বশেষ এক লাখ ২১ হাজার ১০ জন মানুষ টিকা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭২ হাজার ৮০০ জন পুরুষ ও ৪৮ হাজার ২১০ জন নারী রয়েছেন। এদিন টিকাগ্রহীতার মধ্যে ২৩ জনের শরীরে মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। এর আগের দিন এক লাখ ১৮ হাজার ৬৫৪ জন টিকা নিয়েছেন। তার আগের দিন এক লাখ ১৪ হাজার ৬৮০ জন টিকা নিয়েছেন। চলতি মাসের প্রথম দিন আরও এক লাখ ১৬ হাজার ৩০০ জন টিকা নিয়েছেন। এর আগে গদত ১৮ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ দুই লাখ ৬১ হাজার ৯৪৫ জন টিকা নিয়েছিলেন। 

সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. মুশতাক হোসেন বলেন, টিকা গ্রহণে আগ্রহ ওঠানামা করতেই পারে। কারণ যাদের বয়স চল্লিশোর্ধ্ব তাদের কাছে রেজিস্ট্রেশন করার মতো সেই প্রযুক্তি সুবিধা সহজলভ্য নয়। এ জন্য চল্লিশোর্ধ্ব অনেকেই টিকাদান কার্যক্রমের বাইরে রয়ে গেছে। এ ছাড়া আরও সমস্যা রয়েছে, প্রান্তিক একজন মানুষ ইউনিয়ন তথ্যসেবাকেন্দ্রে রেজিস্ট্রেশন করে টিকার জন্য উপজেলা সদরে যাবে। এটি কিন্তু প্রান্তিক মানুষের জন্য একটু কষ্টকর। বাড়ির পাশেই যদি টিকাদান কেন্দ্র করা যায় তাহলে প্রান্তিক মানুষকে আরও বেশি যুক্ত করা যাবে।

তিনি বলেন, টিকাগ্রহীতাদের বয়সসীমা এখনই কমানো ঠিক হবে না। কারণ এখনো চল্লিশোর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ টিকার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের সংখ্যাটা পুরো হয়নি। চল্লিশের কোটা তুলে দিলে তারা অনেকেই টিকা পাবেন না।  এই বয়সের মানুষের করোনা হলে তো একটু মুশকিল। কাজেই এখনই টিকায় বয়সের সীমা কমানো ঠিক হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও মিডিয়া সেলের সভাপতি অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, টিকা গ্রহীতার সংখ্যাটা যে কমে গেছে সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৪৮ লাখেরও বেশি মানুষ টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩৫ লাখেরও বেশি মানুষ টিকা নিয়েছেন। আসলে যে সময়ে টিকাগ্রহীতার সংখ্যা অনেক বেশি ছিলো সেই সময় রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টি শিথিল করা হয়েছিল। স্পটে রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ছিলো। অনেকে আবার রেজিস্ট্রেশন ছাড়াও টিকা নিয়েছে। ৪০ বছরের নিচে কাউকে এখনই টিকা দেয়া যাবে না। সেই শর্ত না মেনেও অনেকে তখন প্রতারণা করে টিকা নিয়েছে। ওই সময়টিতে এসব কারণে টিকাগ্রহীতার সংখ্যা বেড়েছিল। যদিও আমাদের প্রত্যাশা ছিলো সারা দেশে আমাদের দুই হাজার ৫০০ টিকার বুথ রয়েছে। প্রতিটি বুথে যদি প্রতিদিন ১৫০ জন করে টিকা নেয় তাহলে দিনে প্রায় তিন লাখ মানুষ টিকা নিতে পারবে। সে ধরনের প্রস্তুতিও আমাদের আছে।

তিনি বলেন, এখন আমরা গ্রামে টিকা নেয়ায় আগ্রহ কম দেখছি। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে দেয়ার পরেও অনেকে টিকা নিতে আসছেন না। একটা বিষয় হয়েছে যে— ট্রাভেল কষ্ট! উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ইউনিয়নগুলো দূরে হওয়ায় অনেকেই রেজিস্ট্রেশন করেও টিকা নিতে আসছেন না। অনেকে আসছেন না কর্মদিবস নষ্ট হয়ে যাবে এসব ভেবে। এগুলো এখন আমাদের বাস্তব চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়াও যেহেতু আমাদের গ্রাম-গঞ্জে ওইভাবে করোনার প্রাদুর্ভাব ছিলো না, তাই অনেকেই টিকা নিতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। যদিও আমরা সবাইকে টিকা নিতে উৎসাহিত করার  চেষ্টা করছি।

আমারসংবাদ/জেআই