Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

মাটি সরাতেই ১৬ কোটি টাকা অপচয়

জাহাঙ্গীর আলম

মার্চ ৬, ২০২১, ০৮:৩৫ পিএম


মাটি সরাতেই ১৬ কোটি টাকা অপচয়
  • প্রকল্প সংশোধন অনুমোদনের আগেই মাটি সরাতে ঠিকাদার নিয়োগ
  • ঠিকাদার দেড় হাজার টাকা দরে প্রতি ট্রলার মাটি বিক্রি করছেন
  • নৌ-মন্ত্রণালয়কে খতিয়ে দেখতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ
  • ঠিকাদার মাটি বিক্রি করে থাকলে ঠিক করেনি : উপ-প্রকল্প পরিচালক

বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর অবৈধ দখল রোধ, সৌন্দর্য বর্ধন ও পরিবেশের উন্নয়ন সাধনে সরকার ২০১৮ সালে একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৪৭ শতাংশ। কিন্তু প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনের অনুমোদনের আগেই অতিরিক্ত ১৩ লাখ ২২ হাজার ঘনফুট মাটি অপসারণের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

নিয়োগকৃত ঠিকাদার প্রতি ট্রলার মাটি ৮০০ থেকে দেড় হাজার দরে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দিচ্ছেন যা শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ। এটি মোটেই সমীচীন হয়নি। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। কারণ, পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি সংশোধনের অনুমোদন কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, নির্মাণকাজে ভালো ব্রান্ডের সিমেন্ট ব্যবহার না করে কম প্রচলিত সিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি যেনতেন কোনো প্রকল্প নয়, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পের বাস্তব চিত্র।

সম্প্রতি বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সরেজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তাই অর্থের অপচয় রোধে সংশ্লিষ্ট নৌ-মন্ত্রণালয়কে খতিয়ে দেখতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি সুপারিশ করেছে। সরেজমিন প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সার্বিক ব্যাপারে জানতে পিডির সাথে যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

তবে প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) ও বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘সংস্থার দর অনুযায়ী ডিপিপি সংশোধনের প্রাক্কলন প্রস্তাব তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। তাই ব্যয় বেড়েছে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে সংশোধনের অনুমোদন পাওয়া যাবে। কিন্তু তার আগেই অতিরিক্ত মাটি সরাতে ঠিকাদার নিয়োগ করে অর্থের অপচয় করা হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মূল ডিপিপিতেই এটা ছিলো। পরিকল্পনা কমিশন ঠিকভাবে তা তুলে ধরে। নিয়ম মেনেই ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে কাজ করাচ্ছি। জেই অ্যান্ড এসআর এন্টারপ্রাইজ যৌথভাবে এই কাজ করছে। চুক্তি অনুযায়ী সরকারি মাটি বিক্রি করার নিয়ম ঠিকাদারের নেই। যদি করে থাকে তা ঠিক করেনি বলে জানান তিনি। 

নৌ-মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার চারপাশে চার নদীর তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকার ২০১৮ সালের ২২ মে অনুমোদন দেয়। যাতে অবৈধ দখল রোধ করা যায়, দখলমুক্ত অংশের সৌন্দর্য বর্ধন করা যায়, নদীর উভয় তীরের পরিবেশগত উন্নয়ন সাধন করা যায়। একই সাথে নদীর দখলমুক্ত তীরভূমিতে অবকাঠামো নির্মাণ করে ব্যবহার করা যায়। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। আর বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৪৭ শতাংশ। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৭৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।   

কিন্তু নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় দ্বিতীয় সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে বিআইডব্লিউটিএ থেকে। তাতে এক লাফে ব্যয় ৩৩২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বা ৩৯ দশমিক ১৯ শতাংশ বাড়িয়ে এক হাজার ১৮১ কোটি ১০ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। আর প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের জুন থেকে এক বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এর প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হচ্ছেন বিআইডব্লিউটিএর সদস্য (অর্থ) নুরুল আলম এবং উপ-প্রকল্প পরিচালক মতিউল ইসলাম।

সূত্র জানায়, আইএমইডি সারা বছরই বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করে। তারই অংশ বিশেষ এই প্রকল্পটিও ফেব্রুয়ারি মাসে সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের অর্থেও অপচয় রোধে নৌ-মন্ত্রণালয়কে খতিয়ে দেখতে বলেছে। কারণ হচ্ছে, মূল ডিপিপিতে নদীর অভ্যন্তরে ওয়াকওয়ের পাশে অতিরিক্ত ১৩ লাখ ২২ হাজার ঘনফুট মাটি অপসারণের কথা বা অঙ্গ ছিলো না। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনে তা উল্লেখ করে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রতি ঘনফুট ১২০ টাকা দরে ১৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরে ঠিকাদারকে কাজ করতে বলা হয়েছে। ঠিকাদারের লোকজন মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় সেই মাটি সরিয়ে প্রতি ট্রলার ৮০০ থেকে দেড় হাজার টাকা দরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। দ্বিতীয় সংশোধনের অনুমোদনের আগেই এমন কাজ শৃঙ্খলা পরিপন্থি হিসেবে বিবেচিত। অন্যদিকে মাটি অপসারণ করা সরকারি অর্থেরও অপচয় বলে প্রতীয়মান। কারণ এই মাটি নিলামে বিক্রি করা গেলে সরকারি কোষাগারে জমা হতো। অপসারণ করা মাটি বিনামূল্যে জনগণকে দেয়া হলে এই অতিরিক্ত অর্থের অপচয় হতো না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, একই সাথে অবকাঠামো নির্মাণকাজে বহুল প্রচলিত ও ভালো ব্রান্ডের সিমেন্ট পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম প্রচলিত সিমেন্টও ব্যবহার করা হচ্ছে। একই সাথে প্রকল্পের কিছু কিছু এলাকায় নদীর পাড়ে বনায়ন করা হলেও অধিকাংশ গাছের চারা মরে গেছে। প্রকল্প এলাকা হচ্ছে— ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ, উত্তরখান, তুরাগ, মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গিরচর, কোতোয়ালি, মিরপুর থানা। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ জেলা সদর, বন্দর, সোনারগাঁও এবং গাজীপুর সদর থানায় নদী তীরে প্রকল্পের কাজ হচ্ছে।

আমারসংবাদ/জেআই