Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

তৃণমূলে সংঘাত সতর্ক কেন্দ্র

রফিকুল ইসলাম

মার্চ ৯, ২০২১, ০৭:৪০ পিএম


তৃণমূলে সংঘাত সতর্ক কেন্দ্র
  • চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রের আরও কঠোর হতে হবে

মুখোমুখি সংঘর্ষ ও হামলা মামলায় নাকাল তৃণমূল আওয়ামী লীগ। তৃণমূলের দায়িত্বশীল নেতাদের বিভেদের রাজনীতির কারণে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। আর এই দ্বন্দ্বের মূল নেতৃত্বে রয়েছেন স্থানীয় সাংসদ ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ পদধারী নেতারা। তাদের ইন্ধনে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে সংঘর্ষ হচ্ছে প্রায়ই। দলীয় কোন্দলে ক্ষুব্ধ তৃণমূলের ত্যাগী, পরিশ্রমী ও দায়িত্বশীল নেতারা।

তারা বলছেন, চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রের আরও কঠোর হতে হবে। যদিও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সিনিয়র ও বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, কিছু কিছু জায়গায় অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে— এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। জাতীয় বা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন লাভ, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও পদ-পদবি লাভ নানা কারণে এই সমস্যাগুলো হয়। তবে সৃষ্ট সকল কোন্দল নিরসনে কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না।

আ.লীগ সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে সফলতার সাথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার একযুগ পার করেছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতার এ দীর্ঘ সময়ে দলটির বিরুদ্ধে মাঠের আন্দোলন-সংগ্রামে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও সফল আওয়ামী লীগ। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনের পাঁচ ধাপেই জয়ের আধিক্য ধরে রেখেছে ক্ষমতাসীন দলটি। ভোটের মাঠ কিংবা বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সফল হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিজ দলীয় কোন্দল। দলটির এমপি-মন্ত্রীদের প্রকাশ্যে পক্ষপাতিত্বে ভাই-লীগ ও এমপি-লীগে ভরপুর তৃণমূল। দেশের বিভিন্ন স্থানে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে ঘটছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, হানাহানি, মারামারি। মামলার দায় মাথায় নিয়ে ভিটেবাড়ি ছেড়েছেন অনেকেই।

তৃণমূল সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের আলোচিত নাম মির্জা কাদের। নিজ দলীয় এমপি ও দায়িত্বশীল নেতাদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, চাকরি বাণিজ্য, ভোট ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপকর্মের সাথে যুক্ত থাকায় মুখ খোলেন তিনি। মির্জা কাদেরের এমন বক্তব্যের পর প্রকাশ্যে আসে নোয়াখালী আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। বেশ কয়েক দফা হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ গত সোমবার অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে দুই দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই দিন প্রথমে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত খানের ওপর হঠাৎ হামলা করা হয়। অভিযোগ ওঠে বসুরহাট পৌরসভার মেয়রের নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয়। এ দিন রাতে বসুরহাটের বঙ্গবন্ধু চত্বরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানস্থল ও বসুরহাট বাজারে মিজানুর রহমান ওরফে বাদলের (উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক) নেতৃত্বে উল্টো হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এ সময় হামলা-ভাঙচুর করা হয় পুরো এলাকা। অভ্যন্তরীণ ওই দ্বন্দ্বের জের ধরে উত্তপ্ত পুরো উপজেলা। বসুরহাট পৌরসভার মেয়রের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত খানের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল মানববন্ধন করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। বসে নেই মির্জা কাদের। গতকালই তিনি বলেন, আমাদের জাতীয় নেতারা কেন চুপ করে বসে আছেন! আমি জানি না। ওনাদের হস্তক্ষেপে যারা অপরাজনীতি করেন, তাদের সঙ্গে আমি রাজনীতি করবো না। প্রয়োজনে আওয়ামী লীগে থাকতে না পারলে আমি শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠা করা বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করবো। আমার আধিপত্য বিস্তারের দরকার নেই। আমার কাছে অস্ত্র নেই। অস্ত্র দিয়ে আমি রাজনীতি করি না। বসুরহাট পৌরসভা কার্যালয়-সংলগ্ন বটতলায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কাদের মির্জা এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, দলে বর্তমান সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক দুজন জাসদের লোক। দুজনকে আমি জাসদ থেকে এনেছি। আমি কারো গিবত করতে চাই না। সবাইকে পুনর্বাসন করেছি। খিজির হায়াত জাসদের প্ররোচনায় ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছেন।

এর আগে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে গত রোববার চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ থানার আরেফিন নগরে ছাত্রলীগের দুগ্রুপের সংঘর্ষে মো. ইমন রনি (২৫) নামে এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ছাত্রলীগের দুপক্ষে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। ওই দিন রাত পৌনে ১১টার দিকে লাশ চমেক হাসপাতাল জরুরি বিভাগে আনা হলে খুনিদের বিচারের দাবি করে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্রলীগের একটি অংশ। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগই দুই ভাগে বিভক্ত। 

বলয়-ভিত্তিক ও বিভেদের রাজনীতির কারণে দ্বন্দ্ব ও কোন্দলে জর্জরিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। সর্বশেষ গত ৫ মার্চ বেলা ১২টার দিকে উপজেলা পরিষদ চত্বরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের উপস্থিতিতে বর্তমান মেয়র এমরান উদ্দিন জুয়েল ও মেয়রপ্রার্থী এম এ আজিজ গ্রুপের সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এতে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। এ ঘটনার পর থেকে উভয়পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। এছাড়া দেশের অধিকাংশ জেলা, মহানগর, উপজেলাসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদধারী নেতা ও স্থানীয় সাংসদরা। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, যে সব প্রভাবশালী নেতা নিজেদের মধ্যে কোন্দলের সৃষ্টি করছেন তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

তথ্য মতে, তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল দূর করতে কঠোর অবস্থানে আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন জেলা-উপজেলার সঙ্গে। বিরোধের মূল কারণ বের করে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখার কাজ শুরু করছেন তারা। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, গ্রুপিং বা দ্বন্দ্ব-কোন্দল মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধ তৃণমূল চান তারা। এমন অভিযোগে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। 

নিজেদের মধ্যে হামলা-মামলা খুবই দুঃখজনক উল্লেখ করে লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান আমার সংবাদকে বলেন, অনেক স্থানে নিজেদের বিভেদের রাজনীতি আছে। সৃষ্ট এই সকল কোন্দল নিরসনে আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। ইতোমধ্যে বেশকিছু স্থানে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও শীর্ষ নেতাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এই সকল দ্বন্দ্বে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল । এই দলের নেতাকর্মী অনেক। তাই ছোট ছোট কিছু ঘটনা মাঝে মধ্যেই ঘটে। তবে বিষয়গুলো আওয়ামী লীগ ছোট করে নিচ্ছে না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আমারসংবাদ/জেআই