Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

ক্ষুদ্র মশায় নাজেহাল দুই সিটি

মার্চ ১২, ২০২১, ০৮:১৫ পিএম


ক্ষুদ্র মশায় নাজেহাল দুই সিটি
  • দুই সিটি আগে থেকেই মশা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিলে নগরবাসীকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না -বাহরানে সুলতান বাহার, সভাপতি, ভাড়াটিয়া পরিষদ
  • এক সপ্তাহ পরপর নতুন কীটনাশক ছিটাতে হবে এবং পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হলেই মশকনিধন সম্ভব হবে -অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার, কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক
  • মশা বৃদ্ধির বেশ কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম বিভিন্ন খাল ও ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করা -মোবাশ্বের হোসেন, নগর বিশ্লেষক

মশা ক্ষুদ্র, কিন্তু মশাতেই নাকাল ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। অতীতেও যেমন এবারো কি তেমনি মশাতেই নাজেহাল হতে হবে দুই সিটি কর্পোরেশনকে? নাকি মশা মেরে নিজেদের শক্তির জানান দেবে— এমনটাই এখন দেখার বিষয়; বলছেন মশায় অতিষ্ঠ রাজধানী ও এর আশপাশের বাসিন্দারা।

মশা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব, সংশ্লিষ্ট বিশেজ্ঞরা বার বার এ কথা বললেও কেন মশায় বন্দি জনজীবন, কেনইবা সম্ভব হচ্ছে না নিয়ন্ত্রণ— এমন প্রশ্নে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, কীটনাশক যদি একটানা পাঁচ বছর ব্যবহার করা হয়, সে  ক্ষেত্রে যেকোনো প্রতিরোধ অসহনশীলতা তৈরি হয়ে যায়। এছাড়া মশা যেহেতুে জলাশয়ে বেশি বংশবিস্তার করে সে ক্ষেত্রে সেখানে সমপরিমাণ ম্যালাথিয়ন নিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বড়-ছোট জলাশয়ে পানির ভলিউমের ভিন্নতা থাকে বলে সেখানে যে স্প্রেম্যান কাজ করছেন, তাকে স্প্রে করার আগে সব জানতে হবে। তারপর কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। তা না হলে মশার লার্ভা নষ্ট হবে না। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আগে মশককর্মীদের ট্রেনিং দিতে হবে। কী পরিমাণ ওষুধ ফগিং করতে হবে সেই সিস্টেমও তাদের জানাতে হবে। শুধু ডিউটি করলেই হবে না। একটি জায়গাতে কতদিন পরপর ওষুধ দিতে হবে তা সিটি কর্পোরেশনকেই ঠিক করে দিতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ এলাকাভিত্তিক কাউন্সিলরদেরও সরেজমিন এসব তদারকি করতে হবে। তবেই মশা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোটা হওয়ায় বর্তমান রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা চলে গেছে পুরোপুরি মশার দখলে। রাজধানী ঢাকা যেনো রূপ নিয়েছে মশার রাজধানীতে। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। বস্তি থেকে অভিজাত এলাকা। সর্বত্রই মশার আক্রমণ। অথচ দুই সিটি কর্পোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণের নানা চেষ্টা করেও কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বলা হচ্ছে, দীর্ঘদিন একই ওষুধ ছিটানোয় মশা ওষুধ সহনশীল হয়ে পড়ায় ওষুধ পুরো কার্যকর হচ্ছে না। এছাড়া নগরীর খাল, নালা পরিষ্কার না করায় বেড়েছে প্রজননস্থল। যেসব এলাকায় মশার প্রকোপ বেশি সেখানে মশারি, কয়েল আর স্প্রেও কোনো কাজে আসছে না। কীটতত্ত্ববিদদের তথ্য বলছে, ঢাকায় অতীতের চেয়ে মশার ঘনত্বও বেড়ে গেছে প্রায় চারগুণ। 

গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মশা মারতে মেয়ররা ব্যর্থ উল্লেখ করে মশার অসহনীয় উপদ্রব থেকে রাজধানীবাসীকে রক্ষার দাবিতে মানববন্ধনে ভাড়াটিয়া পরিষদের এক কর্মী মশারি টাঙিয়ে ফুটপাতে শুয়ে অভিনব প্রতিবাদ জানান। সেখানেও দেখা গেছে, মাঝে মাঝে উঠে বসছেন ওই ব্যক্তি এবং হাত দিয়ে মশা মারছেন। ফের শুয়ে পড়ছেন। হঠাৎ করে আবার মশার কামড়ে ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠছেন। মশার কামড়ে বারবার ঘুম থেকে জেগে উঠছেন তিনি। একটু পরপর উঠেই তিনি বলে উঠছেন— ‘উফ! এত মশা, মশারির ভেতরেও মশা, মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ সবাই।’ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, ‘ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন আগে থেকেই মশা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিলে নগরবাসীকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। বিভিন্ন এলাকায় মশককর্মীদের দায়িত্ব অবহেলার ফল এখন মানুষ ভোগ করছে। তারা সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ অনুযায়ী বাসাবাড়ির আঙিনা, জলাশন, ডোবা  ও ড্রেনে ওষুধ ভালোভাবে ছিটালে মশার বিস্তার এত হতো না। বাড়লেও নিয়ন্ত্রণে আনা যেতো। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশকনিধনকর্মীদের আগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব বিল্ডিংয়ের ছাদ এবং বেজমেন্টসহ বিভিন্ন স্থান পরিষ্কার করতে হবে নিয়মিত। কারণ সেখানে নোংরা অপরিচ্ছন্ন পানি জমে থাকে। এসব বিল্ডিং নজরদারির আওতায় এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’  

রাজধানীর বাড়িওয়ালাদের উদ্দেশেও বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, ‘ভাড়াটিয়া ব্যক্তিদের অভিভাবক হিসেবে আপনাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। আপনারা  নিজ উদ্যোগে আপনার বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন এবং মশকনিধনকর্মীদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে ওষুধ দিন। এতে করে ভাড়াটিয়াদের সাথে আপনাদের পরিবারও সুরক্ষিত থাকবে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুষ্ক মওসুমে স্বাভাবিকভাবেই মশার বিস্তার ঘটে। হালকা গরমে মশার ডিম একসঙ্গে ফুটে যায়। এতে মশার সংখ্যা এমনিতেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এছাড়া দিন শেষে সন্ধ্যা নামার আগেই নালা-নর্দমা, জলাশয় ও ডোবা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা বেরিয়ে আসে। তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বাড়তে পারে ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ। সিটি কর্পোরেশন আগে থেকেই মশার প্রতি কঠোর পদক্ষেপ নিলে নগরবাসীকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। বিভিন্ন এলাকার মশককর্মীদের দায়িত্বে অবহেলার ফল এই শহরের মানুষ ভোগ করছে। তারা সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ অনুযায়ী বাসাবাড়ির আঙিনা, জলাশয়, ডোবা ও ড্রেনে ওষুধ ছিটালে মশার বিস্তার ঘটতো না। বাড়লেও নিয়ন্ত্রণে আনা যেতো।

কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশন যেসব ওষুধ ছিটাচ্ছে তার মান ঠিক আছে। ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের ডোবা, জলাশয় পানিপ্রবাহ চলমান করে দিতে হবে। নর্দমা ও ডোবার পচা পানিতে মশার বিস্তার বেশি হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ড্রেনগুলোতে পানি প্রবাহ নেই, সেখানে মশা নিরপদ স্থান হিসেবে বেছে নেয় এবং বিস্তার বাড়তে থাকে। ফলে কয়েকদিন পরপর ড্রেনের ঢাকনা খুলে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে। একই সঙ্গে ডোবায় লার্ভিসাইড, অ্যাডাল্টিসাইট কিংবা গাপ্পি ফিশ ছাড়তে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি কীটনাশকেরই একটি কার্যকাল রয়েছে। এরপর তার ব্যবহার করা ঠিক নয়। নতুন ওষুধ ছিটাতে হবে। ওষুধ ছিটানোর সময় এবং পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হলে মশকনিধন করা সম্ভব হবে। প্রতি এক সপ্তাহ পরপর ওষুধ ছিটাতে হবে।’

নগর বিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘ঢাকায় মশা বৃদ্ধির বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। তবে লোকালয়ে মশা বৃদ্ধির কারণ বিভিন্ন খাল ও ড্রেনগুলো ময়লায় ভরে আছে। ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। ফাঁকা স্থান দিয়ে মশা ভেতরে ঢুকে সেখানে বিস্তার ঘটায়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব বিল্ডিংয়ের ছাদও অপরিচ্ছন্ন, নোংরা ও পানি জমে থাকে। সেখানে মশার উপদ্রব রয়েছে। বিভিন্ন ভবনের বেজমেন্টে মশার ব্যাপক বিস্তার দেখা যায়। নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্টে পানিও জমছে। সেসব স্থানে মশার উৎপাত দেখা যায়। এখন সিটি কর্পোরেশনকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাতে ড্রেন, ভবনের ছাদ এবং বেজমেন্টে কোনোভাবেই মশার উপদ্রব না বাড়ে।’

এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশান ১০৮ নম্বর সড়কে দুই পাশের ফুটপাতের নিচে ড্রেনের মুখের ওপর পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে দেখা যায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে। ফুটপাতের নিচে ড্রেনে মশার প্রজনন ঠেকাতে এবং সেসব মশা মারতেই মূলত ওষুধ ছিটিয়ে ড্রেনের মুখগুলো পলিথিন দিয়ে বন্ধ করে রাখে ডিএনসিসি। যাতে উড়ন্ত মশাগুলো ড্রেনের ভেতরেই মারা যায়। উড়ে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ যেনো না থাকে। এর আগে শুধু ফুটপাতের ওপরই ওষুধ ছেটানো হতো বলে জানায় ডিএনসিসি। ডিএনসিসি জানায়, গত ৮ মার্চ থেকেই মশা নিধনে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ক্রাশ প্রোগ্রাম চালাচ্ছে ডিএনসিসি। প্রতিটি ক্রাশ প্রোগ্রামে এই প্রক্রিয়াই মশা নিধন করা হচ্ছে। চতুর্থ দিনের মতো বৃহস্পতিবার গুলশান এলাকায় অভিযান চালায় সংস্থাটি। অভিযানে গুলশান গুদারাঘাটে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আগে ফুটপাতের নিচে যে ড্রেন করা হয়েছে, সেখানে একটি টেকনিক্যাল ভুল আছে। এখন থেকে ফুটপাত ও ড্রেন নির্মাণের সময় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং কীটতত্ত্ববিদদের রাখতে হবে। কীভাবে ফুটপাতের নিচে ড্রেন তৈরি করলে একই সঙ্গে পানি অপসারণ হবে আবার মশার প্রজননও যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। ভুল থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। 

তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস গত ৩ মার্চ বলেছিলেন, দুই সপ্তাহ পর হতে মশা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। ঢাকাবাসীকে একটু ধৈর্য ধারণের অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমরা কৌশল পরিবর্তন করেছি। এখন আমরা যে কার্যক্রম নিচ্ছি, আমাদের সকালের কার্যক্রম চার ঘণ্টায় চলছে, বিকেলের কার্যক্রম আমরা আরও বৃদ্ধি করেছি। সুতরাং আমরা আশাবাদী, দুই সপ্তাহ পর থেকে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে ডেঙ্গুর জন্য আমাদের কৌশল পরিবর্তন করে আবার এপ্রিল থেকে আমরা কার্যক্রম আরম্ভ করবো। ডেঙ্গুর কৌশল পরিবর্তন যেমন তেমন, কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী দুই সপ্তাহ প্রায় পার হতে চললেও দৃশ্যত এখনো মশার নিয়ন্ত্রণেই রয়ে গেছে রাজধানী ঢাকা।

আমারসংবাদ/জেআই